সেলের নাম মৃত্যুঞ্জয়ী। ৪১ বছর আগে আজকের এই দিনে এই সেলেই নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম চার রূপকার সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবু হেনা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। সেলের সামনে ধাতবের ফলক। তাতে লেখা ‘মৃত্যুঞ্জয়ী জাতীয় চার নেতার ঘাতকদের বুলেটের চিহ্ন।’
লাল লাল চিহ্নগুলো দেশের ইতিহাসের নির্মম বেদনাদায়ক একটি অধ্যায়ের, দেশের অপূরণীয় ক্ষতির নিদর্শন বহন করছে। ১৯৭৫ সালে, কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন জাতীয় চার নেতা। তারা তিনটি সেলে থাকতেন। এর মধ্যে যে সেলটিতে তাদের হত্যা করা হয় পরবর্তীকালে সেটির নামকরণ করা হয় মৃত্যুঞ্জয়ী সেল এবং ওই তিনটি সেল নিয়ে করা হয় শহীদ স্মৃতিকক্ষ। এই কক্ষের সীমানার প্রবেশমুখেই চিহ্নিত করা আছে হত্যাকাণ্ডের পর চার নেতার লাশ রাখার স্থানটি।
শহীদ স্মৃতিকক্ষে মোট তিনটি সেল ছিল যার মধ্যে তাদের হত্যা করা হয় ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ নামে সেলে যেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ অবস্থান করতেন। অন্য দুজনকেও এই সেলে এনেই হত্যা করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটক থেকে পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে শহীদ স্মৃতিকক্ষ। কারাগারের ফাঁসির আসামিদের জন্য যে কনডেম সেল, এর পরেই নীলনদ নামে বিদেশি বন্দিদের একটি ওয়ার্ড রয়েছে। এরও পর পৃথক সীমানাবেষ্টিত শহীদ স্মৃতিকক্ষ। কক্ষের পাশে স্থাপন করা হয়েছে চার নেতার আবক্ষ ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের নিচে তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। শহীদ স্মৃতিকক্ষের মৃত্যুঞ্জয়ী সেলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের তৎকালে ব্যবহৃত দুটি করে খাট, চেয়ার ও টেবিল রয়েছে; ভেতরেই গোসলখানা। সেলের সামনে একটি ছোট জানালা। তারা বন্দি থাকাকালে এটি সবসময় তালাবদ্ধই থাকত। শুধু খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভেতরে পাঠানোর প্রয়োজন হলে জানালাটি খোলা হতো। পাশেরই দুটি সেলে আবু হেনা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ছিলেন। সেল দুটোয় একটি করে খাট, চেয়ার ও টেবিল রয়েছে, রয়েছে গোসলখানা এবং ছোট একটি করে জানালাও। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় সব আসবাবই স্বচ্ছ কাচবেষ্টিত। ৪১ বছর পর, আজও সেভাবেই আছে তাদের ব্যবহৃত আসবাবগুলো। এগুলো বয়ে চলেছে দেশের চার নেতার শেষ কয়েকটি দিনের স্মৃতিচিহ্ন।
কারাগারের সুদৃঢ় নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভ্যন্তরে এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সে বছরই মাস তিনেক আগে, ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ এই চার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা-পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু-পাল্টা ক্যুর মধ্যেই বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য কারাগারে প্রবেশ করে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। সেই থেকে প্রতি বছরের মতো এই দিনটি জেলহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে পুরো জাতি।
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় গঠিত বাংলাদেশ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটক থাকাকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। তাজউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন তিনি। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী মেহেরপুরে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হন। স্বাধীনতার পর তিনি যোগাযোগমন্ত্রী ও তৎপরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। আর আবু হেনা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মেহেরপুরে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী ছিলেন। স্বাধীনতার পরও তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন।