নামের সাথে আছে ‘ভাই’ শব্দটি। এ নিয়ে অনেকেই মনে করেন গডফাদার বলেই তাঁর নামের সাথে ওই ভাই। কিন্তু ‘ভাই’ তাঁদের বংশপদবী। তাঁদের পরিবারের সকলেরই নামের শেষে ভাই পদবী আছে। এমনকি নারীদের নামের সাথেও রয়েছে। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত হিসেবে তাঁর নাম এসেছিল। ওই মামলার তিনিও আসামী। এই ভাই হলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এককালে ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাফিয়া বলা হয় তাঁকে। কেউ বলেন, তিনি মাফিয়া নন, দাপুটে ব্যবসায়ী। চলচ্চিত্র শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। আরও অসংখ্য পরিচয় আছে তাঁর। সব মিলিয়ে বহুল আলোচিত এক মানুষ তিনি।
বাংলাদেশের রহস্যময় ব্যক্তিদের তালিকা করলে প্রথমদিকেই থাকবে তাঁর নাম। যাকে নিয়ে আছে নানা গল্প, নানা রহস্য। আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে এসব গল্পের বেশিরভাগই চলচ্চিত্র জগতের নারী ও হত্যা কেন্দ্রিক। এ গল্পের কতটুকু সত্য আর কতটুকু মুখরোচক বা মিথ্যা সে নিয়েও আছে নানা মত। বুধবার চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের এক নম্বর আসামী আশীষ রায় চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের পর আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নামও ঘুরছে সবার মুখে মুখে। আজ থেকে ২৪ বছর আগে আজিজের সাথে বাগবিতণ্ডার জেরেই সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করা হয়।
কে এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই?
উইউকিপিডিয়ার তথ্যমতে, আজিজ মোহাম্মদ ভাই একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। তিনি হত্যা ও মাদক পাচারসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ৫০টির মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি।
১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ১৯৬২ সালে আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয় আরমানিটোলায়। আজিজ মোহাম্মদ ভাই তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা ব্যবসা-বাণিজ্য, চলচ্চিত্র প্রযোজনার সাথে সক্রিয়ভাবে নিযুক্ত ছিলেন।
পার্টিতে অন্যান্যের সাথে আজিজ মোহাম্মদ ভাই। ছবি: সংগৃহীত
তিনি সার্ক চেম্বার অব কমার্সের আজীবন সদস্য। অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড ও বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মালিক।
এছাড়াও মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে রয়েছে তাঁর হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা। মাদক ব্যাবসার সাথে তাঁর জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তিনি সার্ক চেম্বারের আজীবন সদস্য। বলা হয়, মুম্বাইয়ের ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে রয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবরে এককবার আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসায় অভিযান চালানো হলে সেই বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মদ ও মাদক, ক্যাসিনো খেলার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
সেদিন বসবাসের ঘরে এত বিপুল পরিমাণ মদের মজুদ দেখে রীতিমোত হতবাক হয়ে যান অভিযান পরিচালনাকারীরা।
মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসা থেকে উদ্ধারকৃত মাদক ও ক্যাসিনো সরঞ্জাম । ছবি: সংগৃহীত
‘ভাই’ তাঁদের বংশপদবী। তাদের পরিবারের সকলেরই নামের শেষে ভাই পদবী আছে। এমনকি নারীদের নামের সঙ্গেও ভাই পদবী রয়েছে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ভাই। মায়ের নাম খাদিজা মোহাম্মদ ভাই।
১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। তাঁদের পরিবার মূলত পারস্য বংশোদ্ভুত। তাঁরা ‘বাহাইয়ান’ সম্প্রদায়ের লোক। ‘বাহাইয়ান’ কে সংক্ষেপে ‘বাহাই’ বলা হয়। উপমহাদেশের উচ্চারণে এই ‘বাহাই’ পরবর্তীতে ‘ভাই’ হয়ে যায়।
ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ১৯৬২ সালে আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয় আরমানিটোলায়। পারিবারিক সূত্রে আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজেও শুরু করে ব্যবসা। দিনে দিনে বাড়তে থাকে তাঁর অর্থ সম্পদ।
পরিবারের সদস্যদের সাথে আজিজ মোহাম্মদ ভাই। ছবি: সংগৃহীত
কিছু সূত্র জানায়, মুম্বাইয়ের ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে রয়েছে আজিজ মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ব্যবসার পাশাপাশি ৯০ এর দশকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এমবি ফিল্মসের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসেন। চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকে নাকি নায়িকাদের রূপের মোহে, নাকি কালো টাকা সাদা করতে, নাকি শুধুই ব্যবসায়িক মানসিকতায় প্রযোজনায় আসেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে।
তবে এসেই যে তিনি নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেন, এটি সবাই জানেন। সেই সময়কার পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মিডিয়া মালিক ও সাংবাদিকরা সমীহ করে চলতো তাঁকে। ৫০টির মত চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। দেশের বিজ্ঞাপন জগতে গ্ল্যামার আনতেও তাঁর ভূমিকা ছিলো।
এরশাদের আমলে একবার তিনি গ্রেপ্তার হন। প্রচলিত আছে এক নারী নিয়ে দ্বন্দ্বের কারনেই এরশাদ তাঁকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। পরে, প্রিন্স আব্দুল করিম আগা খানের সুপারিশে মুক্তি পান আজিজ মোহাম্মদ ভাই। চলচ্চিত্র নায়িকাসহ বিভিন্ন নারীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এর সম্পর্ক নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প ছড়াতে থাকে। একজন পত্রিকা সম্পাদককে হত্যার অভিযোগও আসে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু, সেটাকে পরে হার্ট অ্যাটাক বলে প্রচার করা হয়।
চিত্রনায়ক সালমান শাহ ও সোহেল চৌধুরীর হত্যাকাণ্ডে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নাম এসেছে। ছবি: সংগৃহীত
তবে তিনি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন ১৯৯৭ সালে। সে সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র অস্বাভাবিক মৃত্যুর (হত্যাকাণ্ড) ঘটনায়ও অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু, সেটাকে আত্মহত্যা বলেই প্রচার করা হয়। যদিও সালমান শাহ’র পরিবার ও তাঁর ভক্তদের ধারণা এটা হত্যাকাণ্ড। সালমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুইবার জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় আজিজকে। কিন্তু কোন প্রমাণ না পাওয়া পাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এর দুই বছর পর খুন করা হয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে। এ হত্যাকাণ্ডেও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তাঁর পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।