মার্চ ২৬, ২০২৩, ০২:৪৮ পিএম
দৈনিক আজাদ পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ছিলেন চিশতি শাহ হেলালুর রহমান। থাকতেন সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (তখন ইকবাল হল)। ছাত্ররাজনীতির সাথেও যুক্ত ছিলেন। হল ছাত্র সংসদের পাঠাগার সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
সেদিনের ঘটনা ও চিশতি শাহ হেলালুর রহমান সম্পর্কে জানা যায় তাঁর সহপাঠী ও বাংলা একাডেমির সাবেক কর্মকর্তা মফিজুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু’ রচনা থেকে।
তিনি লিখেছেন, ‘সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের দু’শো বারো নম্বর কক্ষটি অনেক স্মৃতিতে বিজড়িত। কে জানতো, হলের দারোয়ান শামসু, স্টুয়ার্ড জলিল, ছাত্র কালাম, মনির, তাহের, জাফর আলম, কাইয়ুমের সঙ্গে ওই কক্ষটির অতি পরিচিত সংগ্রামী, নিবেদিত প্রাণ সাংবাদিক বন্ধুটিকেও আমরা হারিয়ে ফেলবো।...
‘সাবেক ইকবাল হলে মার্চের ৫ তারিখে চিশতি প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে সালাম জানায় ও শপথ গ্রহণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। তার সাথে ছিলেন হল সংসদের তৎকালীন সহ-সভাপতি জনাব জিন্নাত আলী, ছাত্রলীগের হল শাখার দপ্তর সম্পাদক গোলাম মোস্তফা ও আমি।
‘...হলের পাশের দোকানদার খালেক চিশতির মৃত্যু সম্বন্ধে আমাকে বলেছিল।
‘পঁচিশে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী যখন ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে তখন চিশতি দোতলায় ওর জানালার পাশের হল আর অডিটোরিয়ামের মাঝামাঝি শেডটির ওপর লাফিয়ে পড়ে।
সারাটা রাত ওই শেডের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকে চিশতি। জীবনমৃত্যুর লড়াই হলো সারারাত।
‘পূর্বের আকাশ ফরসা হয়ে গেছে। সারারাত গুলিবর্ষণের পর পাকিস্তানী হায়েনাদের যন্ত্রগুলো তখন নিশ্চুপ। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছে, চিশতি হয়তো তাই ভেবেছিল।
‘হানাদার বাহিনীর কেউ কোথাও আছে কিনা দেখার জন্য চিশতি যখন মাথাটা সামান্য উঁচু করলো, ঠিক তখনই খালেকের দোকানের সামনে পাহারারত হানাদার কুকুরটা তেড়ে এলো।
‘নুরু নামের এক রিক্সাওয়ালাকে লাশ কুড়িয়ে এক জায়গায় জমা করার জন্য বাধ্য করা হচ্ছিল। চিশতি শেডের ওপর থেকে লাফ দিতে চাইলে ও বাধা দিয়ে বললো, “পাইপ বেয়ে নেমে আসুন স্যার, লাফ দিবেন না।”
হলের সামনে পুকুরের পাশে মেজর। তার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো চিশতিকে।
‘দৈনিক আজাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে নিজের পরিচয় পেশ করলো চিশতি।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। হলের পেছনদিক থেকে ডাইনিং হলের দিকে যেতে যে সরু রাস্তাটা— তারই পাশে ড্রেনের কাছে গাছটির নীচে দাঁড় করিয়ে পর পর তিনটি গুলি করা হলো চিশতীকে।
...প্রথম গুলিটি যখন ওর বুকের বামপাশ ভেদ করে বেরিয়ে গেল, তখনই তিনি “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন।
‘চিশতি কি কোন বধ্যভূমিতে পচে গলে মাটির সাথে গিয়েছিল, নাকি বর্বর বাহিনী পেট্রোল দিয়ে তার দেহটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তা আমরা কেউ জানতে পারিনি।’
(স্মৃতি: ১৯৭১, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯০, সম্পাদনা রশীদ হায়দার-- বই থেকে সংগৃহীত)
তাঁকে নিয়ে আরও একটি লেখা পাওয়া যায়। সেখানে তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়-
মুক্তিযুদ্ধে ২৬ মার্চের কালরাত্রিতে এক তেজোদ্দীপ্ত ঘাড়ত্যাড়া তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের গেইটে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় আমরা যাকে সর্বকনিষ্ঠ শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে পাই। স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সকল আন্দোলনে, লড়াই সংগ্রামের মঞ্চে, রাজপথে। সাংবাদিক ছিলেন। বগুড়া শহরেই জন্ম, দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অলিগলি! পড়তেন বগুড়া জেলা স্কুলে৷ বঙ্গবন্ধুর সাথে একটা মজার বাৎচিতের গল্প আমাদেরকে ভীষণ আনন্দ দেয় এখনও! ইকবাল হল সংসদের পাঠাগার সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সহ সভাপতি, দৈনিক আজাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার চিশতি হেলালুর রহমান শহীদ হয়ে গেলেন!
চিশতি হেলাল কবি নির্মলেন্দু গুণের বন্ধু ছিলেন৷ হুমায়ূন আহমেদের সহপাঠী। ছাত্রলীগের রাজনীতির মাঠে ছিলেন সিরাজুল আলম খানের সহযোদ্ধা৷ তাঁদের লেখায় আমরা চিশতি হেলাল সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জানি৷ প্রত্যক্ষদর্শী খুররম মমতাজ জানাচ্ছেন-
"ছাব্বিশে মার্চ একাত্তর ভোর বেলা। চিশতি ভাইকে রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে পুকুর পাড় থেকে হলের অডিটরিয়ামের দিকে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন পাকিস্তানি সৈন্য। এরপর কয়েক মুহূর্ত পরে একটা গুলির শব্দ ভেসে আসে। চিৎকার চিশতি হেলাল বলছিলেন- 'হামাক মারে ফাল দিল! হামাক মারে ফাল দিল!!'
চিশতি হেলাল ভাইয়ের এটাই শেষ কথা৷"
দৈনিক আজাদ কর্তৃপক্ষ পত্রিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রিপোর্টার চিশতি হেলালের পরিবারকে বায়াত্তর সাল থেকে পরবর্তী দশ বছর ধরে প্রতি মাসে ১২০ টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷
আমাদের কেউ জানালো না আজ পর্যন্ত তাঁর পরিবারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন কিনা দৈনিক আজাদ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ৷
আশির দশকে শহীদ চিশতি হেলালের নামে বগুড়ায় একটা সড়কের নামকরণ করা হয়৷ লাগানো হয়েছিলো সাইনবোর্ড। এক দুই বছর পরে সাইনবোর্ড উধাও হয়ে যায়৷ তাঁর বাড়ির সড়কে মানুষকে জিজ্ঞেস করলেও কেউ চেনেনা চিশতি হেলালকে৷ দুই হাজার সালের দিকে একটা স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ হয়েছিলো শহীদ বুদ্ধিজীবী চিশতি হেলালের নামে।
বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের তিতাস-অসীম কমিটির কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছিল চিশতি হেলালকে কোনোভাবে সম্মানিত করা যায় কিনা!
আসলেই সত্যি কিনা!
বাংলাদেশ শহীদ চিশতি হেলালের কবরের সন্ধান পায়নি৷ চিশতি হেলালের পরিবারের খোঁজ বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালীন সময়ে করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে প্রথমবার বঙ্গবন্ধু বগুড়ায় আসলে শহীদ বুদ্ধিজীবী চিশতি হেলালের বাবাকে ডেকে নেন৷ একটা আবেগঘন আলাপ হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু ও চিশতি হেলালের পিতার মধ্যে৷ জেলা আওয়ামীলীগের কেউ কি জানেন ঘটনাটা! সরকারের কেউ!
এসব ভুলে তুমি কিভাবে ভালো থাকো প্রিয় স্বদেশ!