অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, ইভিএম বাতিলসহ ১৪ দফা ঘোষণা গণতন্ত্র মঞ্চের

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ০৪:১৫ পিএম

অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, ইভিএম বাতিলসহ ১৪ দফা ঘোষণা গণতন্ত্র মঞ্চের

বিএনপিঘোষিত ১০ দফা সমর্থন করে যুগপৎ আন্দোলন এবং সরকার ও শাসনব্যবস্থার বদলে ১৪ দফা ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। সোমবার (১২ ডিসেম্বর) নারী ও শিশুকল্যাণ পরিষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ১৪ দফা ঘোষণা করেন গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও নাগরীক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।

গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলো হলো-জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

১৪ দফা ঘোষণার সময় মঞ্চে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ছাড়াও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সদস্য সচিব নুরুল হক নুর , ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাউয়ূম উপস্থিত ছিলেন।

গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফায় যা থাকছে:

১. বর্তমান অনির্বাচিত ও অবৈধ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্র হরণকারী লুটেরা ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।

২. অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমান অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন, দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। এই নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসাবে 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' নিশ্চিত করতে নির্বাচনে টাকার খেলা ও মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ, অগণতান্ত্রিক আরপিও সংশোধন, প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পরিবর্তন সাধন, জনগণের বাঁচার জরুরি সংকটের সমাধান, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করে পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার বাতিল করবে। রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক রুপান্তরের লক্ষ্যে সাংবিধানিক ক্ষমতা কাঠামো এবং রাষ্ট্র পরিচালনার আইন কানুন সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্য তৈরিতে সহায়তা করবে, যাতে করে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ এই গণতান্ত্রিক সংস্কার করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
৩. ক) সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের উৎস প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রীক জবাবদিহিতাহীন স্বেচ্ছাচারী কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হবে। ন্যায়পাল ও সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠনের আইন প্রনয়ণ করা হবে।


খ) সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থাভোট ও বাজেট পাশ ব্যতিরেকে সকল বিলে স্বাধীন মতামত প্রদান ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
গ) প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি ও দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
ঘ) প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরন, শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাসহ বিকেন্দ্রিকৃত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ কার্যকরি স্বাধীনতা নিশ্চিতসহ গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা হবে।
ঙ) রাষ্ট্রের হিসাব ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানসমূহের আইন সংস্কার করা হবে।

৪. বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হিসাবে দণ্ডপ্রাপ্ত সকল বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সাজা বাতিল, সকল হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও সকল রাজনৈতিক কারাবন্দীদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।

৫. সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং এ কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। বিরোধী দলসমূহের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশী বাধা, হামলা, গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা বেআইনী হিসাবে গণ্য করা হবে পেশাগত দায়িত্বের বাইরে পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দলীয় পেটোয়া বাহিনী হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীসমূহকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। স্বৈরাচারী কায়দায় বিরোধী কন্ঠস্বরকে দমন করতে নতুন কোন মামলা করা যাবে না, গায়েবী মামলায় বিরোধী দলসমূহের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না।
৬. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সকল নির্যাতনমূলক কালাকানুন বাতিল করতে হবে। গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। ইতিপুর্বে সংগঠিত সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনের যথাযথ তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশী ব্যবস্থার নামে শ্রমিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

৭. ক) জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে খাদ্যপণ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার সিন্ডিকেট মুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান অভাবের পরিস্থিতিতে গ্রাম- শহরের গরীব ও স্বল্পআয়ের পরিবারসমূহের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা ও নগদ অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

খ) গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পানিসহ সেবামূলক খাতসমূহে স্বেচ্ছাচারী পন্থায় মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ডুবে থাকা রেন্টাল–কুইক রেন্টাল প্রকল্প ও এই খাতে দেয়া দায়মুক্তি আইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

গ) সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত, সুলভে গণপরিহনের ব্যবস্থা ও বাসভাড়ার যৌক্তিক সীমা নির্ধারণ করা হবে।

৮. বিগত বছরগুলোতে, বিশেষ করে গত ১৫ বছর ধরে বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, শেয়ার মার্কেট, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসহ রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে সংগঠিত রোমহর্ষক নজিরবিহীন দুর্নীতি ও এর দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করতে শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে। দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচারের সাথে যুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে দ্রুত কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৯. গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সকল নাগরিকদের উদ্ধার করতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশনের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন - নিপীড়নের প্রতিটি ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা হবে।

১০. সাম্প্রদায়িক উসকানি সৃষ্টি করে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপসানালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাদের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

১১. ক) স্বাস্থ্যকে সম্পদ হিসাবে বিবেচনা ও 'বিনা চিকিৎসায় কোন মৃত্যু নয়' এই নীতির ভিত্তিতে সমগ্র স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও বেসরকারি খাতে মুনাফার লাগাম টেনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে।

খ) 'শিক্ষা অধিকার, বাণিজ্যিক পণ্য নয়' এই নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে সবার জন্য একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত, মাতৃভাষায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে জিডিপি'র ন্যুনতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ প্রদান করা হবে।
১২. রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১৩. কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, পাটকল - চিনিকলসহ বন্ধ কলকারখানা চালু, শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের বাঁচার মত মর্যাদাপূর্ণ মজুরি ঘোষণা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

 

১৪. জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারষ্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি ও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক সমস্যাদির সমাধান করতে হবে।

Link copied!