নভেম্বর ৩, ২০২২, ১২:১৮ এএম
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ছোট বোন ডাক্তার সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি। বর্তমানে তিনি কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য। তিনি প্রথমে সিলেট এবং পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে যুক্তরাজ্যে যান। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সাধারণ সদস্য ছিলেন সৈয়দা জাকিয়া। বর্তমানে তিনি রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছেন।
ঢাকার গুলশানের বাসায় দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন ইতিহাসের জঘন্যতম জেল হত্যাকাণ্ডের শিকার তাঁর বাবার রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং সেদিনের সেই বিয়োগান্তুক ঘটনা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অধরা ইয়াসমিন।
দ্য রিপোর্ট
যদিও শৈশবেই আপনি আপনার বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হারিয়েছেন। তারপরও তাঁর সাথে আপনার বহু স্মৃতি আছে। সেসব থেকে যদি কিছু বলতেন।
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছি। বাবা মানেই আমাদের কাছে বিশাল এক শুণ্যতা। যে বয়সে বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানোর কথা, বাবার কবিতা শোনার কথা, সেই বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। তারপরও কিছু স্মৃতি আছে। আমার বাবা অত্যন্ত শান্ত একজন মানুষ ছিলেন। বেশি কথা বলতেন না। কিন্তু তিনি অত্যন্ত দৃর চিত্তের একজন মানুষ ছিলেন। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন বাবাকে দেখেছি রাজনীতি নিয়ে খুব ব্যস্ত এক মানুষ হিসেবে। খুব কম সময় আমরা তাঁকে কাছে পেতাম। আমরা তখন ময়মনসিংহে থাকতাম, আর আব্বা ঢাকায় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। হঠাৎ দেখতাম রাতে আব্বা বাসায় এসেছেন, আবার খুব ভোরেই তিনি চলে যাচ্ছেন। তারপর তো সেই ঊনসত্তর, সত্তর, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলো। তখন খুব কমই বাবাকে কাছে পেয়েছি।
দ্য রিপোর্ট
৩ নভেম্বর ইতিহাসের মর্মান্তি ওই ঘটনার দিন আপনি কোথায় ছিলেন? ওই দিনের কোনো ঘটনা কি মনে আছে আপনার?
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
আমাদের ভাড়া বাসা তখন ইত্তেফাক অফিসের কাছে। সত্যি বলতে ৩ নভেম্বরের কথা বলার আগে আমাকে তাঁর একদিন আগের কথা বলতে হবে। আমরা জেলখানায় কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলাম আব্বাকে দেখতে। অনেক কথা হলো, আমার আব্বা সেদিন খুব চিন্তিত ছিলেন। আম্মা তখন আব্বাকে বললেন, মেয়ে দুটি সারাদিন কান্নাকাটি করে, ওদের একটু বুঝায়ে দেন। তখন আব্বা আমাদের কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, চিন্তা করো না। আমরা খুব তাড়াতাড়িই তোমাদের কাছে ফিরে আসবো।
তারপর ৩ রা নভেম্বর ভোর বেলা। আমরা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পাগলা ঘণ্টির শব্দ শুনলাম। সাধারণত জেল খানায় কোনো অঘটন ঘটলে পাগলা ঘণ্টি বাজানো হয়। ওই ঘন্টা বাজানোর পর থেকেই আমরা চিন্তিত ছিলাম। সারাদিন চলে গেলো। কোনো খবর আর পেলাম না। পরেরদিনও একই অবস্থা। জেলখানার মধ্যে কী হয়েছে, সেসব নিয়ে নানা রকম কানাঘুঁষা আর গুজব চললো। আসলে কী হয়েছে আমরা তখনো কিছুই বুঝতে পারলাম না। এরপর ৫ তারিখ এল। এদিনই আমার আব্বা তাঁর দেওয়া কথা মতো ফিরে এলেন, তবে নিথর দেহ নিয়ে। গুলিতে ঝাঁঝরা এক বুক নিয়ে।
দ্য রিপোর্ট
জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত তাঁদের বিচারের রায় কার্যকর করার প্রক্রিয়া কতদূর এগিয়েছে?
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ৩ রা নভেম্বরে জাতীয় চার নেতাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। তারপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসলেন। এরপর সংসদে কুখ্যাত ইন্ডিমিটি বিল পাশ করে সে। ফলে জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের বিচার ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আমরা বিচারের জন্যে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি। বিচার পাইনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে প্রথম যে কাজটি করলেন, সেই কুখ্যাত ইন্ডিমিটি বিল বাতিল করলেন এবং জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করলেন।
দ্য রিপোর্ট
জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ছিলেন, জানা গেছে কি?
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
এটা আমাদের কাছেও একটা প্রশ্ন যে, ১৯৭৫ সালের ৩ রা নভেম্বর জেলখানার মতো পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে এতবড় হত্যাকাণ্ড হলো, সেটি কয়েকজন সিপাহী বা জুনিয়র অফিসারদের দ্বারা তো ঘটানো সম্ভব না। তাঁরা হয়তো হুকুম কার্যকর করেছে, কিন্তু পরিকল্পনাটা কাদের ছিলো, সেটি তো এখনো জানা গেল না।
দ্য রিপোর্ট
পরে ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কোনো কমিশন গঠনের দাবি করা হয়েছিল কিনা?
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
কমিশন গঠনের দাবি সব সময়ই ছিল এবং একবার গঠনও করা হয়েছিল। সেটার নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দুইজন নামকরা রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। কিন্তু বাংলাদেশে এসে তাঁরা সেই সময় কাজ করবেন, সেই সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়নি। পরে সে উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখন আমি আশাবাদী যে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা যেভাবে তাঁর ও আমার পিতা হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছেন, সেভাবেই কমিশন গঠন করে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মুখোশ উন্মোচন করবেন।
দ্য রিপোর্ট
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর ইতিহাস থেকে তাঁদের অবদান মুছে ফেলার অপচেষ্টা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি জাতীয় চার নেতার যে অবদান রয়েছে সেগুলো বর্তমান প্রজন্মের কাছে আরো বিস্তৃতভাবে জানানোর আপনারা কী করছেন?
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
সত্য ইতিহাস জাতি যত জানবে, তত সেই জাতি আত্নপ্রত্যয়ী হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ রা নভেম্বরের পর আমাদের দেশ উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে। মিথ্যে ইতিহাসকে গ্রাস করল। একটি পুরো প্রজন্ম বিভ্রান্ত হলো। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, সত্যিকারের ইতিহাসটা মানুষকে জানানোর। যে জাতি তাঁর গর্বের ইতিহাস যত জানবে, সে জাতি তত আত্নপ্রত্যয়ী হবে, তত শক্তিশালী হবে।
দ্য রিপোর্ট
জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি যারপর নাই কমিটেড ছিলেন। বিশ্বাসী ছিলেন। বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কি আগের মতো এমন কমিটম্যান্ট বা বিশ্বস্ততার গুণ দেখেন? নাকি ঘাটতি আছে কোনো?
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
যুগের সাথে একটা পরিবর্তন আসে। আমার আব্বার সাথে জাতির জনকের পরিচয় ১৯৪৮ সালে। তার পর থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, পারস্পরিক আস্থার জায়গা তৈরি হয়। সেটিই কিন্তু বাংলাদেশের আন্দোলন, সংগ্রামে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। আমার পিতা তাঁর নেতার প্রতি দারুণ অনুগত ছিলেন, সেটি আমার নিজেরও দেখা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোস্তাক আমার আব্বাকে ফোন করে নানা রকম প্রলোভনও দেখায়। মন্ত্রী সভায় নেওয়া হবে, এমনও বলেন। আমার আব্বা খুব শান্ত মেজাজের লোক ছিলেন। মোস্তাকের সেই প্রস্তাবের দিন তাঁর মতো মানুষও সেদিন রেগে যান। তিনি বলেন, নেতার সাথে বেঈমানী করবো না। জাতির পিতার রক্তের উপর পা দিয়ে মন্ত্রী সভায় শপথ নিতে পারবো না। সাফ সাফ জানিয়ে দেন তিনি। এতটাই তিনি তাঁর নেতার প্রতি অনুগত ছিলেন।
আমাদের পিতারা সৌভাগ্যবান, তাঁরা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেতে পেরেছেন যে, নেতার প্রতি তাঁদের বিশ্বস্ততা বা আস্থার জায়গাটা। এখন যাঁরা রাজনীতিতে আসছেন, সবারই এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে। রাজনীতি, দল করতে হলে একটা চেন অব কম্যান্ড মানতে হয়। এগুলো কিন্তু আমাদের পুর্বপুরুষ যাঁরা রাজনীতি করে গেছেন, তাঁদের থেকে শিক্ষা নিয়ে করতে পারি।
দ্য রিপোর্ট
জাতীয় চার নেতার পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে এই সময়ে জাতীয় চার নেতার আদর্শ কিংবা দর্শনের প্রতিফলন দেশের রাজনীতিতে কতটুকু ঘটছে বলে আপনি মনে করেন।
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী পুরোন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যে দলের কর্ণধার ছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। সেই দল এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে যে উন্নয়নের ধারায় চলছে, সেটি বিস্ময়কর। অনেকটাই সফল হয়েছে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় এবং তাঁর দৃঢ়তায়।
জাতীর জনক যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, জাতীয় চার নেতার স্বপ্নের কোনো পার্থক্য ছিলো না। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্র নিয়েই তারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছেন। এখনো আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাঁর পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। আমাদের পিতাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য।
দ্য রিপোর্ট
আপনার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনাবোধ কবে থেকে জেগে উঠে? মানে আপনি রাজনীতিকে কখন থেকে প্যাশন হিসেবে নিয়েছেন?
সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি
আমার জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে। ১৯৭০ সালের শেষ দিকের ঘটনা। আব্বা একদিন বললেন, ‘চলো, আমার নেতার কাছে নিয়ে যাব।’ মা টিফিন ক্যারিয়ার সাথে নিলেন। তাতে ভাতও ছিল। আমরা গেলাম মধুপুর গড়ের একটি বাংলোয়। নেতার সাথে মিটিং হলো আব্বার। সেখানে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, ছেলে শেখ রাসেলও ছিল।
আমি, আমার ছোট বোন রূপা আর শেখ রাসেল মধুপুরের জঙ্গলে খেলা করছিলাম। আমাকে নিয়ে তিনটি কাঠি দিয়ে রাসেল বাংলাদেশের পতাকা বানিয়েছিল। তখনো বাংলাদেশের পতাকা স্বীকৃতি পায়নি। খুব সম্ভবত রাসেল ছোট ছোট পতাকাগুলো ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিল। মধুপুরের জঙ্গলে আমরা মিছিল করলাম। বললাম, জয় বাংলা। ওই দিন থেকে আমি মনে করি, চেতনাটি জেগেছিল। তখন আমার বয়স সাত বছর। সেই দিনটি আমার স্মৃতিপটে চিরদিন জ্বলজ্বল করবে।