ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ, এমডির দাবি ৯৫ শতাংশ পানি সুপেয়

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২, ০১:৩৬ এএম

ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ, এমডির দাবি ৯৫ শতাংশ পানি সুপেয়

রাজধানীতে পানি সরবরাহের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটি দীর্ঘ ৫৯ বছরেও পানির সংকট ও সুপেয় পানির অভাব দূর করতে পারেনি বলে জনগণের অভিযোগ রয়েছে। ফলে বছর জুড়েই সমালোচনার মুখে পড়ছে ঢাকা ওয়াসা। তবে সাড়ে পাঁচ মাস আগে পানিতে দুর্গন্ধ পেলেও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এখন আর পান না। তাঁর দাবি, ওয়াসা যেখান থেকে পানি উৎপন্ন করে সেখানে পানি প্রায় শতভাগ সুপেয়। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় পাইপ লাইন লিকেজ হয়ে কনটামিনেশন হয়।’

ওয়াসার পানির মান নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। বছরে বছরে আন্দোলন-মানববন্ধনের পরও পানির মান নিয়ে জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি ওয়াসা। এখন পানির মান এতোটাই খারাপ হয়েছে যা ফুটালেও দুর্গন্ধ দূর হচ্ছে না। গোসল করলে শরীর চুলকায়। ঢাকা ওয়াসার বিকল্প কোনো সংস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে ওয়াসার পানি দিয়ে মানুষ গোসল করছেন ঢাকাবাসী। আর খাবারের পানির জন্য মসজিদ-মাদ্রাসায় অনেকে দীর্ঘ লাইন ধরে অপেক্ষায় থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর জুরাইন, মাতুয়াইল, মিরপুর-১০, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকটের সাথে পানির দুর্গন্ধ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বাসিন্দারা। পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় মাদরাসার স্থাপিত সাবমারসিবল ওয়াটার পাম্পের পানি দিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছেন মাতুয়াইলের বাসিন্দারা। ওয়াসার পানি পান করলে ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ।

যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ওয়াসার পানি পান যোগ্য নয়, দুর্গন্ধ আর ময়লা থাকছে। পানি পান করলে ডায়রিয়ার হয়। মসজিদ ও মাদরাসা থেকে পানি এনে পান করছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) তথ্য মতে, আইসিডিডিআরবি ১৯৬২ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এতো রোগীর চাপ সামাল দিতে হয়নি কখন। রাজধানীতে ডায়রিয়া উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। প্রতিদিন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ডায়রিয়া রোগী বেশির ভাগ যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শনিরআখড়া, মোহাম্মদপুরের। কেবল আইসিডিডিআরবি নয়, অন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেও কমবেশি ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছে। বাসায় থেকেও অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।

সুপেয় পানির দাবিতে সাধারণ জনগণের পাশপাশি রাজধানীর জনপ্রতিনিধিরাও সোচ্চার হয়ে মাঠে নেমেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫২,৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত কাউন্সিলর খালেদা আলম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ঘোলা ও দুর্গন্ধ ছাড়াও নানা ধরনের জীবাণু রয়েছে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে। গত ১০ বছর ধরে ঢাকা ওয়াসার পানির সংকট ও দুর্গন্ধ দূরীকরণে জুরাইনের বাসীরা দাবি জানিয়ে আসছেন কিন্তু কোনো সমাধান আসছে না। বাধ্য হয়ে, সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানববন্ধন করতে হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার পানির দুর্গন্ধ নিয়ে আন্দোলন করে আলোচনায় আসা মিজানুর রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘ওয়াসার পানির দুর্গন্ধ দূরীকরণে ২০১২ সাল থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার দরখাস্ত ঢাকা ওয়াসা বরাবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজও কোনো সমাধান আসেনি। ফলে বাধ্য হয়ে, মসজিদ থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করছেন তিনি। মিজানুরের মতো মাহবুব নামে আরেকজন দীর্ঘদিন জুরাইনে বসবাস করতেন। কিন্তু পানির দুর্গন্ধ ও গ্যাস সংকটের কারণে জুরাইন ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়েছেন।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘ঢাকাবাসীর কাছে সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহের প্রাথমিক শর্ত ঢাকা ওয়াসা পুরন করছে না। নদীর পানি শোধন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করতে গিয়ে পানি দূষিত হচ্ছে। দূষিত পানি পানে মানুষ কলেরা ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার এমডি চোখ বন্ধ করে দাবি করেন, তাঁর পানি ভালো। তিনি নিজেও বলেছেন ওয়াসার পানি আইসিডিডিআরবিতে পরীক্ষা করিয়েছেন। পানি সরবরাহের প্রথম উৎস থেকে পরীক্ষা করলে সেটি তো ভাল হতেই পারে। কিন্তু মাঝখানে পানি সরবরাহের বিশাল পাইপ লাইনে পানি দূষিত হচ্ছে। পানিতে ময়লা, দুর্গন্ধ, কেঁচো ও ঘোলা রং দেখতে পাওয়া যায়। সুতরাং ওয়াসার পানিতে সুপেয় ও নিরাপদ করতে হবে। যদি সেটি না করা যায়, তাহলে ঢাকা ওয়াসার পেছেনে জনগণের যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সেটি বিফলে যাচ্ছে।’ 

তবে ঢাকা ওয়াসার পানি সংকট ও দুর্গন্ধের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন  প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস আগের নিজের ভোল পুরোপুরি পাল্টিয়ে দাবি করে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা শতভাগ পানি সরবরাহ করতে পারে। তবে পাইপ লাইন অনেক পুরনো ও ভাঙা-চোরা। এখান থেকে লিক হতে পারে, লিক থেকে কনটামিনেশন (দূষণ) হতে পারে। তবে ওয়াসা যেখান থেকে পানি উৎপন্ন করে সেখানে পানি শতভাগ সুপেয়। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় পাইপ লাইন লিকেজ হয়ে কনটামিনেশন হয়।’

চলতি বছরের গত ৬ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা ইউটিলিটি রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডুরা) আয়োজিত এক সংলাপে পানিতে দুর্গন্ধ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার এমডি বলেছিলেন, ‘আমি পল্টনে থাকি। আমার বাসায়ও পানির স্মেলটা আছে।’ নগরবাসীর চাহিদা- ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা’ শীর্ষক ওই সংলাপে তাকসিম এ খান নগরবাসীকে পানি ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দেন।

ওয়াসা যেই পরিমাণ পানি উৎপাদন করে, সেই পরিমাণ পানি গ্রাহকের কাছে যায় উল্লেখ করে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে ওয়াসার এমডি বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশে আইসিডিডিআরবি পানির মান পরীক্ষা করেছে। তাতে দেখা গেছে, শতকরা ৯৫ ভাগ জায়গায় পানি পান যোগ্য। পাঁচ শতাংশ জায়গায় পানিতে কনটামিনেশন মিলেছে। তখন আমরা পাঁচ শতাংশ ঠিক করে দিয়েছি। মাঝে মাঝে পাইপগুলো লিক থাকায় কনটামিনেশন হয়। বাইরে থেকে পাইপ লাইনে ময়লা ঢুকে। তবে শতকরা ৯৫ শতাংশ জায়গায় পানি সুপেয়।

Link copied!