জুন ১৮, ২০২৫, ০৬:১২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পার হলেও জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস কাটেনি। তার ভাষায়, ‘মানুষ এখনো সরকারকে শত্রু মনে করে।’
গত ১২ জুন ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের প্রথম শর্ত দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। সরকারের প্রতিটি স্তরে এবং প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত দুর্নীতির শিকড় ছড়িয়ে আছে। তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট বানাতে, ব্যবসার লাইসেন্স নিতে— সব জায়গায় ঘুষ দিতে হয়। প্রতিটি স্তরে লুটপাট চলে। সরকারকে মানুষ শত্রু ভাবে, যাকে প্রতিনিয়ত প্রতিহত করে টিকে থাকতে হয়।’
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র ও সাধারণ জনতার যৌথ আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ বহুদিন ধরে বিশ্বাস করে আসছে, সরকার তাদের কিছুই দেয় না। আমি এমন একটি রাষ্ট্র গড়তে চাই, যেটা তাদের কিছু ফিরিয়ে দেবে।’
ড. ইউনূস মনে করেন, শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও বিদ্রোহের পেছনে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, কর্মসংস্থানের অভাব ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। শেখ হাসিনার শাসনামলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবনতি হয়েছিল, বিরোধীদের দমন করা হচ্ছিল এবং ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাত তলানিতে পৌঁছেছিল।
তিনি বলেন, ‘বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও ভেঙে পড়া প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়েছি আমরা। সরকার নিজের ব্যয় মেটাতে পারবে কি না তখনও আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিয়েছে, সেটি আসলে ঋণ নয়, উপহার; কারণ তা আর কোনোদিন ফেরত আসবে না।’
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চলতি বছরের জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো নির্বাচনী ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন এবং জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমে সংস্কারের সুপারিশ দেয়। ড. ইউনূস জানান, তিনি আগামী জুলাইয়ের মধ্যেই সব রাজনৈতিক দলকে একত্র করে ‘জুলাই সনদ’ নামে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পন্ন করতে চান, যাতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম হয়।
‘এই চুক্তি হবে এমন, যা বাংলাদেশে আগে কখনো হয়নি,’ বলেন ইউনূস। ‘কমিশনের সুপারিশগুলো শুধু কসমেটিক পরিবর্তন নয়। এটি প্রশাসন ও রাজনীতিকে মৌলিকভাবে বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা।’
সব দলের সব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সহজ হবে না স্বীকার করে তিনি বলেন, বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল এবং তারা দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। তবে তারা একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দুই মেয়াদের সীমাবদ্ধতা প্রত্যাখ্যান করছে। একে নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘তবুও এখন আলোচনার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটা বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি। আমরা এমন একটা রাষ্ট্র চাচ্ছি, যেটা সত্যিকার অর্থে জনগণের জন্য কাজ করবে।’
সাক্ষাৎকারে তিনি তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ‘সামাজিক ব্যবসা’ নিয়ে নতুন পরিকল্পনার কথাও বলেন। স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য খাতে সামাজিক উদ্যোক্তাদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে চান তিনি। ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রেও আনুষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যাংকিং কাঠামো গড়ে উঠুক তা তিনি চান।
ইউনূস বলেন, ক্ষুদ্রঋণকে নিয়ে ভুল ধারণা ছড়ানো হয়েছে। কিছু ঋণদাতা অতিরিক্ত সুদ আরোপ করায় মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ‘মাইক্রোক্রেডিট’ এমন নয়। এই মডেল পৃথিবীর অনেক দেশে কার্যকরভাবে চলছে। এটা ঠিক করার কিছু নেই, ‘মাইক্রোক্রেডিটে’ কোনো ভুল নেই।
ড. ইউনূসের মতে, প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় দরিদ্রদের প্রবেশাধিকার নেই। অথচ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ধনিক শ্রেণি ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেয় না। ফলে ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়ে এবং সাধারণ মানুষ নিজের সঞ্চিত অর্থ তুলতেও পারে না।
শেখ হাসিনা একসময় তাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করতেন। অথচ সেই সরকার পতনের পর তিনিই হন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। ইউনূস বলেন, ‘আমি জানি, এই দায়িত্বে থাকলে সমালোচনা হবেই। আগে আমাকে আক্রমণ করত আওয়ামী লীগ, এখন করে সবাই। এটা স্বাভাবিক।’
তিনি বলেন, ‘আমার কাজ হলো এই অন্তর্বর্তী সময়ের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা। আমরা এমন একটি ভিত্তি গড়ে দিতে চাই, যেখান থেকে সত্যিকার অর্থে একটি নতুন বাংলাদেশের সূচনা হতে পারে।’