২ দিনে ৩০ ঘণ্টা বাস চালিয়ে ক্লান্ত চালক। ঘুমচোখে ভোরবেলা খুলনা থেকে আবার যাত্রা শুরু করলেন। গন্তব্য ঢাকা। দূরপাল্লার গাড়ি ফাঁকা রাস্তা পেয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। নিয়ন্ত্রণ হারালো ঘুমে ঢুলুঢুলু বাসচালক। এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ছিটকে ১০০ ফুট নিচে আন্ডারপাসের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দুমড়েমুচড়ে গেল ইমাদ পরিবহনের বাসটি। মৃত্যু বরণ করে নিলো চালকসহ ১৯ জনকে।
রবিবার (১৯ মার্চ) সকালে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। চালক জাহিদ হাসান ক্লান্ত দেহে ঘুমচোখে অতিরিক্ত গতিতে বাস চালানোয় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় হাইওয়ে পুলিশ।
হাইওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গতকাল ভোর চারটার দিকে খুলনার ফুলতলা থেকে ইমাদ পরিবহনের বাসটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ভোর ৫টা ৫ মিনিটে খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে বাসটি যাত্রী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়। বাসটির চালক সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারান। এতে বাসটি এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে ছিটকে পড়ে। এরপর কমপক্ষে ১০০ ফুট নিচে এক্সপ্রেসওয়ের আন্ডারপাসের দেয়ালে সজোরে ধাক্কা লেগে বাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই চালক জাহিদ হাসান, তাঁর সহকারী ইউসুফসহ ১৭ জনের মৃত্যু হয়। চিকিৎসার জন্য ১২ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে বাসটির সুপারভাইজার মিনহাজসহ আরও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়।
খুলনা, পিরোজপুর ও সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় যাত্রী আনা নেওয়া করে ইমাদ পরিবহন। সাত মাস আগে এই চালক হিসেবে যোগ দেন জাহিদ হাসান (৪০)। জানা যায়, বিশ্রামের কোনো সুযোগই পান না ওই পরিবহনের বাসচালকেরা। বিরতিহীনভাবে বাস চালাতে হয় তাদের। সেই ধকলের পরিণতি ১৯ জনের মৃত্যু।
ইমাদ পরিবহনের চালক জাহিদ হাসান বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ে যান পিরোজপুরে। পরদিন শুক্রবার সকালে পিরোজপুর থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসেন। সেদিন বিকেলেই আবার যাত্রী নিয়ে যান পিরোজপুরে। রাতে পিরোজপুর পৌঁছে পরদিন শনিবার সকালে আবার যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসেন। দুপুরে আবার বাস চালিয়ে যান খুলনায়। সেখানে রাতে যাত্রী নামিয়ে বাসে তিন-চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে রবিবার ভোর ৪টায় আবার ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এভাবে তিনি গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় বাস চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বাবার লাশ শনাক্ত করতে এসে চালক জাহিদ হাসানের ছেলে রাতুল হাসান জানান, সপ্তাহে এক দিন বাসায় আসার সুযোগ পান তাঁর বাবা। বৃহস্পতিবার বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকা, পিরোজপুর, খুলনা রুটে পাঁচটি ট্রিপে বাস চালিয়েছেন তিনি। ফোনে কথা হলে রোববার ঢাকায় ফিরে বাসায় এক দিন বিশ্রাম নেওয়ার কথা বললেও চির বিশ্রামে চলে গেলেন তিনি।
জাহিদ ক্লান্ত ছিলেন এমন কথা কাউকে জানাননি বলে ইমাদ পরিবহনের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, বাসচালকদের বিশ্রামের জন্য প্রতিটি জায়গায় ব্যবস্থা করা আছে।
আহত এক বাসযাত্রী জানান, হাইওয়েতে বাসটি বেপরোয়া গতিতে চালানো হচ্ছিল। যাত্রীরা কয়েক দফা বারণ করলেও চালক কারও কোনো কথা শোনেননি বলে জানান তিনি।
এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে ফরিদপুর জোনের হাইওয়ে পুলিশ সুপার মাহাবুবুল হাসান বলেন, বাসটির ফিটনেসে ও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েতে যেন অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চলতে না পারে, সে জন্য কাজ চলছে।
এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানায়, বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না। ফিটনেস সনদের মেয়াদও পেরিয়ে গিয়েছিল।
দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। উদ্ধার করা মরদেহগুলোর সুরতহাল করেছেন শিবচর হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক আবদুল্লাহেল বাকী। তিনি বলেন, বাসের প্রথম অংশের যাত্রীরা মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের মধ্যে ৮ জনই গোপালগঞ্জের। বাকি ১১ জনের মধ্যে খুলনার ৪ জন, বাগেরহাটের ২ জন, ফরিদপুর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পাবনার ১ জন করে।