এপ্রিল ৩০, ২০২৩, ০৯:১০ পিএম
“সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বা সোশ্যাল সেফটি নেট (এসএসএন) কর্মসূচী'র আওতায় সরকার প্রদত্ত বয়ষ্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা এবং শিক্ষা উপবৃত্তির পরিমাণ বর্তমান উচ্চ বাজারদর বা মূল্যস্ফীতির তুলনায় অতি নগন্য।”
এমন মন্তব্য করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, “এসব ভাতা বাড়াতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”
রাশেদ খান মেনন বলেন, “ভাতা সুবিধাভোগী এক নারীকে আমি জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তিনি ভাতার ৫০০ টাকায় নাতির জন্য মুরগী ও কলা কিনবেন। মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্যের বাজার অনুপাতে ভাতার এ পরিমাণ নগন্য। এটি বাড়ানো দরকার।”
তিনি বলেন, "দেশে উন্নয়ন হয়েছে ঠিক। কিন্ত দূর্ভাগ্যবশত দারিদ্র্য সীমা কমিয়ে আনতে পারলেও বৈষম্য এমনভাবে বেড়েছে যে একটা তুলনাহীন জায়গায় চলে গেছে। এই রাষ্ট্র আমরা গঠন করেছি এই কারনে নয় যে এটি একটি বড়লোকের (ধনী মানুষের) রাষ্ট্র হবে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এটি সবার রাষ্ট্র হবে। সাধারণ মানুষের রাষ্ট্র হবে।"
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ক্রিস্টিয়ান এইড এর সহযোগীতায় এক প্রাইমারী সার্ভে'র আউটকাম প্রকাশে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে যৌথভাবে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও তাঁর সহকর্মী এএসএম শামীম আলম শিবলী।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বয়স্ক ও স্কুলগামী শিশুরা যে ভাতা পাচ্ছে তা বাড়ানো তাগিদ দিয়েছে সুবিধাভোগী ও তাঁদের অভিভাবকরা। তাঁদের ৯৭ শতাংশ দাবী করে বয়স্ক ভাতা বৃদ্ধি করে দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং ৮০ শতাংশ শিশুর অভিভাবক মনে করে উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা দরকার।
তিনি বলেন, সার্ভে চলাকালে অভিযোগ পাওয়া যায় যে বয়স্ক ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতার মতো সুবিধাভোগী নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বার সুবিধাভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতমূলক আচরন করে। তাঁরা বাড়ির আশে-পাশের মানুষ ও আত্মীয় স্বজনদের নাম তালিকাভুক্ত করছে। এর ফলে ভাতা বিতরণের যে লক্ষ্য তা ব্যাহত হচ্ছে।
বিদ্যমান নিয়মে বয়স্ক, বিধবা ও হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গের জনগন) ভাতা মাসিক ৫০০ টাকা, প্রতিবন্ধী ভাতা মাসিক ৮৫০ টাকা ও হিজড়া জনগোষ্ঠী ৬০০ টাকা পায়।
উপবৃত্তির ক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিকের একজন শিক্ষার্থীকে মাসিক ৭৫ টাকা, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী মাসিক ১৫০ টাকা এবং এক পরিবারে দুজন শিক্ষার্থী থাকলে দুজন মিলে পায় ৩০০ টাকা। এ ছাড়া কোনো পরিবারে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী থাকলে উপবৃত্তি পায় মাসে ২০০ টাকা।
রাশেদ খান মেনন বলেন, সোস্যাল সেফটি আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিলো এবং এ আলোকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পরবর্তী সংবিধান এ এটি সন্নিবেশিত করা হয়।
“এটি ওয়েলফেয়ার কর্মসূচি। দান খয়রাত নয়। এটি নীচের তলার জনগনের অধিকার। স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায় যদি ওরা খেতে না পায়।”
মেনন তাঁর বক্তব্যে প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকারকে চিঠি দেয়ার জন্য সিপিডি কে পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, এনজিওদের কোনও রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নাই। আর এজন্যই এরা এক্ষেত্রে কাজ করতে চায় না।
তিনি বলেন, “সুদবিহীন ক্ষুদ্র ঋণ শুধু সার্ভিস চার্জ নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী তে অনেক বেশী শক্তিশালী কন্ট্রিবিউশান করা যায়। ক্ষুদ্রঋণ খুবই প্রচলিত। এমনকি, আমরা নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছি বটে কিন্ত এটা কি তৃনমুলে জনগনের প্রকৃত ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করতে পেরেছে কি?”
মেনন বলেন, “পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ যেটা হয় সেটাকে স্যোশাল সেফটি নেট এর হিসেবে করা হয়েছে এতোদিন। এর ফলে মনে হয়েছে এটা এক বিরাট কর্মসূচী। এখন আইএমএফ চেপে ধরায় সরকার এ হিসেব স্যোশাল সেফটি নেট থেকে বাদ দিবে। এতে এ খাতে জিডিপির যে অংশ মনে করা হতো তার আর হবে না। প্রকৃত হিসেব বের হয়ে আসবে।”
তিনি বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের এতো সক্ষমতা নেই যে এ বিশাল স্যোশাল সেফটি কভারেজ এর ৫৪ টি প্রোগ্রাম তাঁরা দেখবে। জনবল নিয়োগ না করলে সম্ভব নয়।
সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যারোমা দত্ত বলেন, “সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগী মানুষের তালিকা করতে ব্যর্থতা থাকলে এ দায় সরকারের একার নয়। সমাজের অন্যান্যদেরও দায় আছে। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে যারা কাজ করছে, তার সম্পদ বাড়ানোতে মতযোগী। ক্ষুদ্র ঋণের ৫ ভাগ কি কন্ট্রিবিউট করা যায় না? একবার আপনারা ভাবেন, আমি ঘরবাড়ি না করে, সম্পদের পর সম্পদ না গড়ে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করতে পারি কি না? আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী খুব দুর্দশার মধ্যে আছে। তাদের কথা কি আমরা ভাবি?”
“সেল্ফ ক্রিটিসিজম এ আসেন, আমরা বড় বড় সেমিনার সিম্পোজিয়াম এ কথা বলছি দেশে দেশে, আমরা আসলে কি করছি? এটি আমার প্রশ্ন, আমি উত্তর চাই।”
তিনি বলেন, বাজেট কিভাবে কতটুকু দেয়া যায় তা আমরা দেখবো। এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আসছে কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আন্তরিক প্রচেষ্টা থেকে। আমরা তাকে আজকের এ বিষয় তুলে ধরবো।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সবসময় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা বলতেন, তাদের ভাগ্য উন্নয়নের কথা বলতেন। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর এ চেতনা বাস্তবায়নে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, এখন এনজিও-র সাপোর্টিভ রোল শুধু নয়, তাদের প্রো-আ্যাকটিভ ও আর্থিকভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোর সময় এসেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, অবকাঠামো খাতে বড় বড় বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা খাতে হয়নি। শিক্ষা খাতে বড় বিনিয়োগ না হলে পদ্মা সেতু পাহারা দেওয়ার জন্য গার্মেন্টস কারখানার মতো বিদেশ থেকে লোক আনতে হবে।
অন্যান্যের মধ্যে ড. মো: আব্দুল আজিজ এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মো: মোক্তার হোসেন ও ক্রিশ্চিয়ান এইড এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার মিজ নুজহাত জেবিন আলোচনায় অংশ নেন।