রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশে গম আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠেছিল ভারত। দেশটি গত শুক্রবার গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এতে বাংলাদেশের বাজারে গমের দাম বেড়ে গেছে, যা আগে থেকেই বেশ চড়া ছিল।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) শুক্রবারের তারিখ দিয়ে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা রপ্তানিতে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। তবে দুটি ক্ষেত্রে রপ্তানি করা যাবে—১. ইতিমধ্যে খুলে ফেলা যেসব ঋণপত্র (এলসি) বাতিলযোগ্য নয়, তার বিপরীতে এবং ২. খাদ্য ঘাটতিতে থাকা দেশের সরকারের অনুরোধের বিপরীতে ভারত সরকার অনুমতি দিলে। বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয় মনে করছে, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও বাংলাদেশ সরকার আমদানি করতে পারবে। তবে দুশ্চিন্তা বেসরকারি খাত আমদানি করতে পারবে কি না তা নিয়ে। দেশের গমের বড় অংশই বেসরকারি খাত আমদানি করে।
খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, সরকারিভাবে গমের মজুত বাড়াতে ভারত থেকে এরই মধ্যে তিন লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ টন গম মঙ্গলবার দেশে পৌঁছাবে। তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে আরও গম আনতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তি করা নিয়ে কথা চলছে। বেসরকারি খাত যদি গম আমদানির ব্যাপারে সহায়তা চায়, তাহলে লিখিতভাবে চাইতে হবে। আমরা অবশ্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সে চেষ্টা করব।’ গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। দেশে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন চাল ও ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। গমের ১১ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গত ১ জুলাই থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মোট ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার টন গম দেশে এসেছে। চাহিদা মেটাতে গম আমদানী করতে হবে আরও প্রায় ২০ লাখ টন।
এনবিআরের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট গম আমদানির ৬৩ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন, ১৮ শতাংশ কানাডা এবং বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়াসহ আটটি দেশ থেকে আমদানি করে।
ভারত গম রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিয়মিত। উৎপাদন বেশি হলেই দেশটি রপ্তানির দরজা খুলে দেয়। দুই বছর ধরে ভারত থেকে বেশি পরিমাণ গম আমদানি করছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানী করা ১৭ শতাংশ গম আসে ভারত থেকে।
রাশিয়া গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর দেশ দুটি থেকে বাংলাদেশে গম আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে আমদানি বাড়িয়ে দেন। এনবিআরের হিসাবে, গত ১ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৮৭ হাজার টন গম আমদানি হয়। এ সময়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে কোনো গম আসেনি। ভারত থেকে এসেছে ৬৩ শতাংশ। বাকিটা এসেছে কানাডা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটি নিজেদের ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি) প্রায় সাড়ে ৬৬ লাখ টন গম রপ্তানি করেছে। এর ৫৭ শতাংশের গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ।
দেশের খাদ্যপণ্য আমদানিকারকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের পর কম আমিষযুক্ত গমের প্রধান উৎস ছিল ভারত। রপ্তানি বন্ধ করায় এখন সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করে ভারত থেকে গম আমদানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কারণ, কম আমিষযুক্ত গমের বিকল্প উৎস দেশ খুব বেশি নেই। তিনি বলেন, অন্য দেশ থেকে আমদানি করলে চড়া দাম দিতে হবে। দেশে উচ্চ আমিষযুক্ত গম দিয়ে ময়দা তৈরি হয়। এ গমের উৎস মূলত কানাডা। আর কম আমিষযুক্ত গমের সঙ্গে কিছু উচ্চ আমিষযুক্ত গম মিলিয়ে আটা বাজারজাত করে বিপণনকারীরা। দেশের বাজারে আটা ও ময়দার দাম আগে থেকেই ব্যাপকভাবে বাড়ছিল।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ঢাকার বাজারে গতকাল শনিবার প্রতি কেজি আটার দাম ছিল ৩৮-৪৫ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি। আর খোলা ময়দার কেজি ছিল ৫৬ থেকে ৬০ টাকা। এক বছরে খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। উল্লেখ্য, দেশের বিস্কুট, রুটিসহ খাদ্যপণ্য ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় রুটি-পরোটার দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে।
ভারতের রপ্তানি বন্ধের খবর ছড়িয়ে পড়লে শনিবার থেকে আটা-ময়দার দাম বাড়তে শুরু করেছে।
সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী বলেন, গমের দাম বেড়ে গেলে চালের ওপরে চাপ বাড়বে। আর এ বছর ঘূর্ণিঝড়, হাওরে ঢলের কারণে ধান উৎপাদন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামনে বন্যার মৌসুমও আসছে। বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের বাজারও অস্থিতিশীল। সরকারের উচিত ভারত ও অন্য গম উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে গম আমদানির জন্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়া।