কৃষক থেকে শুরু করে দিনমজুর সবাই আসতে যাচ্ছে পেনশন ব্যবস্থার সুবিধায়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এই রূপরেখা নিয়ে ইতিবাচক সাড়া মিললেও আপত্তি করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
আমাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে আবার সেই অর্থই ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এই স্কিমটা পুরোপুরি ভুল, এমন হলে পেনশনের কোনও স্কিমই কাজ করবে না
- ড. মো. আকতারুল ইসলাম
সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন
শিক্ষকদের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণার পর থেকেই চলছে বিরোধিতা। আমলাদের চেয়ে সুবিধা কম পাওয়ায় শিক্ষকরা এই স্কিমকে ‘অসম্মানজনক’ হিসেবে অভিহিত করছেন। ঠিক কি কি কারণে এই পেনশনের স্কিম নিয়ে আপত্তি শিক্ষকদের? সেগুলোই আপনাদের সামনে উপস্থাপন করবো। চলুন জেনে নেওয়া যাক-
যে সুবিধা হারাচ্ছে শিক্ষকরা
প্রথমেই আসি কি কি সুবিধা হারাবে শিক্ষকরা। প্রত্যয় স্কিমে ফান্ডে মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা দিতে হবে। যা আগের তুলনায় ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। এদিকে প্রতিষ্ঠান জমা দেবে ১০ শতাংশ। আগে শিক্ষকরা সিজিএফ স্কিমে পেনশন পেত সেখানে প্রতিষ্ঠান জমা দিতো ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ফলে এই স্কিমের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাসিক বেতন থেকে বেশি পরিমাণলাখ অর্থ কাটা হবে।
আরও পড়ুন: প্রত্যয় স্কিম বিতর্ক: সর্বাত্মক কর্মবিরতি ঘোষণা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের
দ্বিতীয়ত, প্রত্যয় স্কিমের আওতায় থাকার ফলে শিক্ষকরা এককালীন অর্থ তুলতে পারবে না। অর্থাৎ আগে মোট পেনশনের অর্ধেক পরিমাণ অর্থ তুলতে পারতেন তারা। যেটি গড়ে ৭০-৮০ লাখ টাকা ছিল। এখন আর সেই সুযোগ নেই। তাকে মাসে মাসে নির্দিষ্ট হারে পেনশন নিতে হবে।
তৃতীয়ত, সরকারি চাকরিজীবীদের মতো সুবিধা পাবে না শিক্ষকরা। সরকারি চাকরিজীবি যারা রাজস্ব থেকে বেতন পান তাদের জন্য সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) রয়েছে। যেখানে তাদের পেনশনের জন্য বেতন থেকে টাকা নয় বরং সরকারই তাদের ফান্ডে অর্থ জমা রাখে। এদিকে তারা অবসরের পর পেনশনের অর্ধেক পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের সুবিধা পাচ্ছে। এই সুবিধা শিক্ষকরা আগে পেলেও নতুন প্রত্যয় স্কিমে সেগুলো পাচ্ছে না।
সবশেষ আমলাদের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কম সুবিধা পাবেন বলে সেটাহচ্ছে কে অসম্মানজনক বলে উল্লেখ করেন শিক্ষকরা। এর আগেও ২০১৬ সালে জাতীয় বেতন স্কেলের গেজেট প্রকাশ করলে সেখানে আমলা ও শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন তারা।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ড. মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, “আমাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে আবার সেই অর্থই ফেরত দেওয়া হচ্ছে। এই স্কিমটা পুরোপুরি ভুল, এমন হলে পেনশনের কোনও স্কিমই কাজ করবে না।”
প্রত্যয় স্কিমে যেমন হবে শিক্ষকদের পেনশনের পরিমাণ
ধরা যাক, একজন শিক্ষক বেতনের ১০ শতাংশের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ টাকা। প্রত্যয় স্কিমে যদি তিনি অংশ নেন তাহলে প্রতিমাসে তার বেতন থেকে কাটা যাবে আড়াই হাজার টাকা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও দেবে একই পরিমাণ অর্থ।
৩০ বছর চাঁদা দিয়ে যাওয়ার পর যখন তিনি অবসরে যাবেন অর্থাৎ ৬০ বছর বয়স থেকে তিনি মাসে ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন।
এছাড়া এই ৩০ বছরে তার বেতন থেকে দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ৯ লাখ টাকায় উন্নীত হবে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও জমা করবে ৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে তার চাঁদার পরিমাণ হবে ১৮ লাখ টাকা।
তিনি যদি ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, তবে ৬০ বছর বয়স থেকে পরবর্তী ১৫ বছরে মোট পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা। যা তার নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।
যেহেতু পেনশনের সুবিধা আজীবন মিলবে, তাই এই অঙ্ক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফার হার বাড়লে মাসিক পেনশনের পরিমাণও বাড়বে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় খরচ সরকার বহন করবে করবে বলে চাঁদাদাতার কর্পাস হিসাব অনুযায়ী জমাকৃত অর্থ ও বিনিয়োগ লব্ধ আয় সম্পূর্ণ চাঁদাদাতার অ্যানুইটি হিসাবায়নের মাধ্যমে মাসিক পেনশন নির্ধারণ করা হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
নতুন স্কিম বনাম পুরনো স্কিম
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, চলমান চার কর্মসূচিতে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৩ জন গ্রাহক হয়েছেন, যার বিপরীতে জমা পড়েছে ৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৩ কোটি টাকা বিনিয়োগও হয়েছে ট্রেজারি বন্ডে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় খুব কমসংখ্যক স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীনস্থ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পেনশন স্কিম আছে। এই ধরনের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা আনুতোষিক স্কিমের আওতাভুক্ত এবং তাদের জন্য সিপিএফ ব্যবস্থা প্রযোজ্য। এই ব্যবস্থায় কর্মচারীরা চাকরি শেষে অবসর-সুবিধা হিসেবে এককালীন আনুতোষিক পান; কিন্তু মাসিক পেনশন পান না। ফলে অবসরোত্তর-জীবনে প্রায় ক্ষেত্রেই আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কর্মচারীদের অবসরোত্তর-জীবনের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে সরকার প্রত্যয় স্কিম প্রবর্তন করেছে। প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা প্রাপ্ত মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা, যেটা কম হয়, সেটা তাদের বেতন হতে কাটা হবে ও সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এরপর উভয় অর্থ ওই প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কর্পাস হিসাবে জমা করবে। এই প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেনশন ফান্ড গঠিত হবে এবং সেই ফান্ড জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ জমাকৃত অর্থের ভিত্তিতে পেনশন দেওয়া হবে।
জমা করা চাঁদার ওপর বিনিয়োগ রেয়াত পাওয়া যাবে এবং প্রাপ্য পেনশন আয়করমুক্ত হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। স্কিমটি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত হওয়ায় এটি শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ। এই স্কিমে নিবন্ধিত কর্মচারী পেনশনযোগ্য বয়সে উপনীত হওয়ার পরবর্তী মাস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ব্যাংক হিসাবে মাসিক পেনশনের অর্থ পাবেন। মুঠোফোনে এসএমএসের মাধ্যমে তাদের বিষয়টি জানানো হবে। এ ক্ষেত্রে তাকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনও দপ্তরে যাওয়ার বা কোনও প্রকার প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজন হবে না।