ঢাবির হলের ১০ তলা থেকে ‘পড়ে’ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩, ০৭:৩২ এএম

ঢাবির হলের ১০ তলা থেকে ‘পড়ে’ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

হলের সামনে পড়ে থাকা নিথর কাজী ফিরোজকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের ১০ তলা থেকে (কেউ কেউ বলছেন ছয় তলা) ‘পড়ে গিয়ে’ গুরুতর আহত হয়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে নিয়ে গেলে সেখানকার চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ছাত্রের নাম কাজী ফিরোজ বলে জানা গেছে। 

মঙ্গলবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। 

এ বিষয়ে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টা ৪০ মিনিটে শাহবাগ থানায় যোগাযোগ করলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা এ এস আই সঞ্জয়  দ্য রিপোর্টকে জানান বিষয়টি সম্পর্কে তারা শুনেছেন। তবে এখনো বিস্তারিত জানতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে একটি ছেলে পড়ে গেছে। তবে সেখানে কী হয়েছে এখনও বিস্তারিত জানি না। তবে হয়ত সে বেঁচে নেই। আমাদের মোবাইল টিম গেছে। ছেলেটিকে তুলে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে।

দিবাগত রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মরদেহ ঢামেকের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা আছে।

ফিরোজের বন্ধুদের কেউ কেউ বলছেন, তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। তবে ফিরোজের ওভাবে ‘পড়ে যাওয়ার’ কারণটি তাৎক্ষণিকভাবে কেউ জানাতে পারেনি।

নিহত শিক্ষার্থী কাজী ফিরোজ চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচার বিভাগের ১৯-২০ সেশনের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হলের ছাত্রলীগেরও সদস্য ছিলেন তিনি।

বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থী শেখ রাব্বী বলেন, ‘আমি দৌড়ে নেমে এসে দেখি, তার হুঁশ নেই। এরপর তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য রিকশায় তুলে দেই। যখন তাকে আমি ধরেছি, তার শরীরটা একদম তুলতুলে ছিল। মনে হচ্ছে, সব হাড় ভেঙে গেছে। তবে তার কোনো ব্লিডিং হয়নি। আর সেসময় আমি তার বুকে হাত দিয়ে দেখেছিলাম পালস ছিল।’

কাজী ফিরোজের এক বন্ধু আবদুল্লাহ বলেন, ‘কবি জসিমউদদীন হল মাঠে আনুমানিক রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় কুশল বিনিময় করলাম। পরে সে আমার মোবাইল নিয়ে কাকে যেন ফোন দিয়েছিল। তখন তাকে ডিপ্রেসড মনে হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর সে আমার মোবাইল ফেরত দিয়ে দেয়। পরে আমি চলে আসি।’

এ দিকে ফিরোজের বেডমেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘‘আমি লাইব্রেরি থেকে যখন রুমে আসি, এর কিছুক্ষণ পর ফিরোজ রুমে আসে। সাড়ে ১০টার দিকে সে সবাইকে বলে, ‘তোরা কেউ আমার কাছ থেকে কোনো টাকা পাস কি না বল। এমনকি দুই টাকা হলেও বল। আমি দিয়ে দিতে চাই। পেলে এখনই বল।’ এর কিছুক্ষণ পর সে মানিব্যাগ এবং মোবাইল রেখে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি বলি, কই যাচ্ছিস? সে বলে, ‘আমি একাত্তর হলে যাচ্ছি, একটু কাজে।’ এরপর আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।’’

ফিরোজের এক রুমমেট বলেন, ‘‘রাত ১০টার পরে সে রুমে আসে। তার জন্য তার টেবিলে খাবার রাখা ছিল। আমি তাকে বলি, খাবার তো নষ্ট হয়ে যাবে। খাবার খেয়ে নে। সে বলে, ‘খামু।’ এরপর সে ওযু করে এসে নামাজ পড়েছে। নামাজ শেষে সে তার টেবিলে বসল। আমরা ভেবেছি, সে হয়ত পড়তে বসেছে। এরপর আমরা রুমের লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। এরপর সে বের হয়ে যায়। এ সময় তার বেডমেট জিজ্ঞেস করল, ‘কই যাস?’ তখন সে বলে, ‘আসতেছি।’ এর অল্প সময় পর আমরা খবর পাই, বিজয় একাত্তর হল থেকে কেউ একজন নিচে লাফ দিয়েছে। এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি শোয়া থেকে উঠে পড়ি। যেহেতু ফিরোজ শেষ কিছুদিন ধরে একটু ডিপ্রেসড ছিল, তাই আমি সবাইকে বলি, ফিরোজ কই? দেখি, রুমে ফিরোজ নেই। এরপর আমরা সবাই দৌড় দিয়ে বিজয় একাত্তরের সামনে আসি। ততক্ষণে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমরা হাসপাতালে এসে দেখি, ফিরোজই।’’

রাত আড়াইটার দিকে ফিরোজের রুমে গিয়ে তার টেবিলে একটি খাতা অর্ধখোলা অবস্থায় রাখা পাওয়া যায়। ফিরোজের বন্ধুরা এটি তার লেখা বললেও এটি কার লেখা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সে খাতায় পৃষ্ঠার ওপরের তারিখের জায়গায় লেখা ছিল ‘১/০৯/২৩’। আর এর নিচে লেখা, ‘মানুষ বাঁচে তার সম্মানে। আজ মানুষের সামনে আমার যেহেতু সম্মান নাই, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার কোনো অধিকার নাই। আমার মৃত্যুর দায়ভার একান্ত আমার। সরি মা! বাড়ি থেকে তোমাকে দিয়ে আসা কথা রাখতে পারলাম না। আমার জীবন নিয়ে হতাশ।... ফিরোজ রাত: ১১টা ৩।’

একই পৃষ্ঠায় নিচে লেখা আছে, ‘আমার ওয়ালেটের কার্ডে কিছু টাকা আছে। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ রইল মায়ের হাতে দিতে। কার্ডের পাসওয়ার্ড ৮০৭৯, আর ফোনের লক খুলে দিয়ে গেলাম। আমার লাশের পোস্টমর্টেম না করে যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোনোরূপ আইনি ঝামেলায় কাউকে যেন জড়ানো না হয়। সবাই বাঁচুক। শুধু শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন আর নষ্ট করতে চাই না।... ফিরোজ।’ এর নিচে লেখা হয়েছে, ‘রাত ১১টা ৫।’

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যতটুকু এভিডেন্স আমাদের কাছে আছে, এটা একটা সুইসাইড। কারণ, তার সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। সে যখন রুম থেকে বের হয়েছে, তার মোবাইল, মানিব্যাগ, সুইসাইড নোট রুমে রেখে এসেছে।’ 

মৃত্যুর মাত্র সাত ঘণ্টা আগেই নিজের ‘ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার’ পরিবর্তন করে ক্যাপশনে লিখেছিলেন: ‘যারা বই পড়াতে অভ্যস্ত তাদের কোনো শত্রু নেই।’ 

তার ঠিক আগেই ফিরোজ নিজের আরেকটি ছবি আপলোড ইংরেজিতে লিখেছিলেন: স্টিল হোপ (এখনও আশাবাদী।)

জিহাদ নামের ফিরোজের এক বন্ধু ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘কেনো করলি ফিরোজ তুই। সকালে ক্লাস তাই ঘুমনোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। এমন সময় বিকট আওয়াজ। জিয়া হল থেকে তুই এই রাত্রে আমার হলেই কেনো আসলি? নিচে গিয়ে ভাবলাম কে না কে কিন্তু তোর আইডি/ছবি দেখার পর আমার শরীর অসুস্থ হয়ে গেলো। কেনো করলি ভাই? সুইসাইড ছাড়া আর কোনো উপায় পাচ্ছিলি না? সেদিনও তোর সাথে সাইকেল চালিয়ে আসলাম নীলক্ষেত থেকে।’’

শফিকুল ইসলাম নামের আরেক বন্ধু লিখেছেন, ‘‘গতকাল ও তোর সাথে দেখা হলো কথা হলো, আর মাত্রই তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেলি। আমি যখন হলে উঠি প্রথম দিনটা তোর সাথেই দেখা হয়, মনে আছে রাতের খাবারটাও তুই খাওয়ালি। আজ তুই নাই ভাবতেই বুক কেঁপে উঠে।’’

নিহতের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে বলে জানা গেছে।

Link copied!