গুরুতর এক অভিযোগ উঠেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অভিযোগটি তুলেছেন শেকৃবির শিক্ষার্থীরাই। অভিযোগ মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট অনুষদের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষক তাহারিমা হক বেগ পড়াতে পারেন না। তাহারিমা হক যখন নিয়োগ পান তখন তাঁর বাবা ড. মো. আনারুল হক বেগ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, অভিযোগটি বেশ পুরোনো। বিষয়টি সম্প্রতি আলোচনায় আসে শেকৃবি শিক্ষার্থী মারিয়ার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা এবং মারা যাওয়ার পর। এ ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে শিক্ষকদের অসহযোগিতামূলক আচরণ, স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিশেষ কিছু শিক্ষকের অযোগ্যতার কথাও।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, গত বছর জুন মাসে উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শিক্ষকদের অসহযোগিতামূলক আচরণসহ অন্যান্য অভিযোগ মৌখিকভাবে অনুষদের ডিন বা অন্যান্য মহলে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়ন করার জন্য ক্লাস অথবা কোর্স পরবর্তী ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা চাই কোর্স পরবর্তী শিক্ষকদের মূল্যায়ন ব্যবস্থা করা হোক।
উপাচার্য বরাবর ওই শিক্ষককে নিয়ে যে অভিযোগগুলো দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, শিক্ষক হিসেবে পাঠদানে অক্ষম তাহারিমা হক বেগ। তাঁকে ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষক থেকে স্থানান্তর করে অন্য যে কোন প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ দেওয়া হোক।
অভিযোগপত্রে শিক্ষার্থীরা আরও উল্লেখ করেছেন, শেকৃবি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) নিয়োগ নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। তবে বাকৃবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ স্নাতকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করা কাউকে বাকৃবিতে পিএইচডি ডিগ্রিতে ভর্তিও করা হয় না। কিন্তু ২০১৮ সালে এগ্রিবিজনেস অনুষদের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগে অধিকতর যোগ্যপ্রার্থী বাদ দিয়ে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তাহারিমা বেগকে নিয়োগ প্রদান করে যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা ও মান সম্মত উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তাহারিমা হক বেগ সম্পর্কে অভিযোগে আওর বলা হয়েছে
১. তিনি লেভেল-৩, সেমিস্টার-১ ব্যাংক ফান্ড ম্যানেজমেন্ট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগেই দিয়েছেন।
২. সিলেবাস অনুযায়ী সম্পূর্ণ অধ্যায় না পড়িয়ে বিভিন্ন ক্লাস টেস্ট ও ফাইনালের স্যাম্পল প্রশ্নপত্র পরীক্ষার পূর্বে দিয়ে থাকেন যার ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করলেও কোর্সের প্রতিটি অধ্যায়ে শেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ।
৩. লেভেল-২, সেমিস্টার-১ এর একটি ম্যাথভিত্তিক কোর্সে তাহারিমা হক বেগ গণিতের পরিবর্তে শুধু তাত্ত্বিক বিষয় পড়িয়েছেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের সাথে সাংঘর্ষিক।
৪. তাহারিমা হক বেগের ক্লাস টেস্ট ও ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্নের মান বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নয়।
৫. তাহারিমা হক বেগ কোনো প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই অনলাইন ও অফলাইনে প্রতিটি ক্লাস ১৫-২০ মিনিটে নেন এবং এভাবে ৮-১০টি ক্লাস নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের আগে কোর্স সমাপ্ত করেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, প্রতিটি ক্লাসের সময় ১ ঘন্টা এবং ৩ ক্রেডিট কোর্সে ৪৮টি ক্লাস নেওয়ার কথা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থী বলেন, শেকৃবিতে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে পোষ্যকোটায় ১০০’র মধ্যে ২৫ পেলেই ভর্তি হওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষক তাহারিমা হক বেগ তাঁর ভর্তির সময়ে ২৫ পেয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর শেকৃবিতে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট অনুষদের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের জন্যে ৮৭ জন প্রার্থী আবেদন করেন। সে সময় তাহারিমা হক বেগের বাবা অধ্যাপক ড. মো. আনারুল হক বেগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
প্রার্থীদের মধ্যে ঢাবি, জাবি, চবি, রাবিসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্যপ্রার্থী ছিল। তাদের অনেকেরই স্পেন, সুইডেনের নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিসহ একাধিক পাবলিকেশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল। এরপরও তাহারিমা হক শিক্ষক হয়েছেন। নিয়ম বহির্ভূতভাবে তাকে নিয়োগের বিষয়টি পত্রিকায় সংবাদ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে বেশ সমালোচিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই একমাত্র শিক্ষক যিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক।
এ বিষয়ে তাহারিমা হক বেগ গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, এসব বিষয় নিয়ে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। প্রেগন্যান্সির জটিলতায় আমি বেশ কিছুদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা নানা কাজে ব্যস্ত ছিলাম, এটা নিয়ে কিছু করা হয়নি। তিনি আমাদেরই এক কলিগের মেয়ে। আমরা সত্যিকার অর্থে এটা নিয়ে বিব্রত। তাঁর নিয়োগই ঠিক হয়নি, এটা সত্য কথা। এখন আমরা তদন্ত করার জন্য একটা কমিটি গঠন করে দিতে পারি।