জন্মান্ধ! তবু থেমে নেই জীবনযুদ্ধ। চোখের আলো না থাকলেও অন্তরের আলোয় আলোকিত একদল দৃষ্টিহীন জীবনযোদ্ধার ভার্চুয়াল শিক্ষালয়ের নাম 'স্কুল অব মাইন্ড লাইট'।দৃষ্টিহীনদের প্রযুক্তিগত পারদর্শিতা অর্জন এবং দৈনন্দিন প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধানে অডিও-ভিজুয়াল, ভিডিও এডিটিং নির্ভর অনলাইনভিত্তিক টিউটোরিয়াল বানানো হয় এই ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে।
এখানে রয়েছে ঘরে বসে কম্পিউটার ও এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ব্যবহারের একাধিক নির্দেশনামূলক টিউটোরিয়াল। নিজেদের চেষ্টায় নিজেদের সম্প্রদায়ের স্বার্থে এই স্কুল থেকে এখন পর্যন্ত ১৫০টির অধিক শিক্ষামূলক ইউটিউব-ফেসবুক টিউটোরিয়াল প্রস্তুত করেছেন মাইন্ড লাইট স্কুলের বিশেষ দক্ষতার (ভিজুয়ালি ইম্পেয়ার্ড) এই তরুণ স্বপ্নদ্রষ্টারা।
'ইউদাউট আই লাইট, ক্রিয়েটিং উইথ মাইন্ডলাইট' স্লোগানে তিন বছর আগে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু হয় অনলাইনভিত্তিক এই স্কুলের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোকলেসুর রহমান এবং প্রথম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফিজিও থেরাপিস্ট রওশান ইয়াজদিন শুভর পরিকল্পনায় প্রাথমিক কাজ শুরু হয়।
ইন্টারেকটিভ ই-লার্নিং সম্পর্কে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের আগ্রহী করে তুলতে এবং প্রযুক্তিগত পারদর্শী করে তুলতে বাংলাদেশে এই উদ্যোগ নেয়া হয় ফেসবুক ইউটিউব এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ব্যবহার করে। তারপর এই যাত্রায় যোগ দেন আরো দুই দৃষ্টিহীন আবু রায়হান এবং আকাশ সরকার। সর্বশেষ স্বেচ্ছাসেবী এই স্কুলের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী আমজাদ হোসেন।
গুগলের স্ক্রীন রিডার, টেক্সট টু স্ক্রীন এবং টকব্যাক প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইউটিউব-ফেসবুক নির্ভর বিভিন্ন টিউটোরিয়াল তৈরি করা হয় এই স্কুলে। মূলত একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধী মানুষেরা আমাদের সমাজে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয় সেই সব সমস্যার সমাধান এবং তার শিক্ষাগত সংকট-সম্ভাবনার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে টিউটোরিয়াল তৈরি করে তারা।
'স্কুল অব মাইন্ড লাইট' প্রতিবন্ধীদের জন্যে ও প্রতিবন্ধীদের দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন বিশেষায়িত স্কুল। আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সকল প্রতিবন্ধীদের জন্যে বাঁধাহীন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নির্মানে কাজ করে যাচ্ছে এই স্কুল। সারাদেশের সকল প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষামূলক এই প্রচেষ্টা জনপ্রিয়তা কুড়াচ্ছে দিনে দিনে।
দৃষ্টিহীন হয়েও আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে মোকলেসদের জানা-বুঝা, ব্যবহার কৌশল, ডিজিটাল যোগাযোগ তৎপরতা সমাজের আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই। জানা-অজানা হাজারও প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়াই করে দক্ষতার সাথে তারা ব্যবহার করছে স্মার্টফোন, ফেসবুক ও ইমেইল। শুধু কী তাই! দেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের একাডেমিক অগ্রগতিও চোখে পড়ার মতো।
‘স্কুল অব মাইন্ড লাইট’ প্লাটফর্মে ভিডিও এডিটিং ও এডমিনের দায়িত্বে আছেন আকাশ সরকার। মাত্র উচ্চমাধ্যমিক শেষ হয়েছে। স্বপ্ন দেখছেন ইংরেজি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার। স্কুল অব মাইন্ড লাইট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, ‘প্রতিবন্ধী মানেই সমাজের বোঝা এই চিন্তার পরিবর্তন করতে হবে। আমি একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও পড়াশোনা করছি। সকল ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে আমি অন্য সকল মানুষের মতোই পারদর্শী। সময় এসেছে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। সঠিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে সমস্যা থেকে সম্পদে পরিণত হবো আমরা’।
স্কুল অব মাইন্ড লাইটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী মোকলেসুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ফিজিক্যাল যোগাযোগ আমাদের জন্য বেশ কঠিন, প্রায় অসম্ভব। এই চিন্তা থেকে শুধু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নয় বাংলাদেশের সকল প্রতিবন্ধী মানুষকে ই-লার্নিংয়ের সাথে পরিচিত করতে আমাদের এই অনলাইন স্কুলের পরিকল্পনা। এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং ডিজিটাল যোগাযোগ কৌশলের পাশাপাশি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে নিজেকে সম্পদে পরিণত করতে হবে তারও নির্দেশনা দিয়ে থাকে
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সকল প্রতিবন্ধী মানুষকে প্রযুক্তি বান্ধব করে তুলতে। আশারাখি সেটা সম্ভব হবে সকলের আন্তরিকতা আর ভালবাসায়’।
স্কুল অব মাইন্ড লাইটের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থী আমজাদ হোসেন।
‘উপযুক্ত শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ সুবিধা পেলে প্রতিবন্ধীরাও যথার্থ মানবসম্পদয়ে উঠতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরাই আমাদের দায়িত্ব নিয়েছি। সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু কিছু বিষয়ে আমাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। কখনও কখনও কিছু ডিভাইস ক্রয় করতে গেলে কিংবা তার ব্যবহার বিষয়ে আমাদের অন্যদের উপর নির্ভর করতে হয়। নতুন হিসেবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
সরকার ও সমাজের দায়িত্বশীল মানুষের কাছে সহযোগিতার আহবান জানিয়ে প্রতি আমাদের সবার একটাই চাওয়া, প্রতিবন্ধীদের চাকরি ক্ষেত্রে,রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে কিংবা তার ব্যক্তিগত জীবন নির্বাহের ক্ষেত্রে যেসকল প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হয় সেগুলোকে আন্তরিকতার সাথে দূর করা কিংবা তাদের সাথে মিশে সমাধানের চেষ্টা করা। প্রতিবন্ধী বলে তার প্রতিবন্ধক্তাকে যেন আমরা অস্বীকার না করি।