৫ বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে ঢাবি শিক্ষকের পাঠদান

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ২৩, ২০২৩, ০৭:৩৬ এএম

৫ বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে ঢাবি শিক্ষকের পাঠদান

মুক্ত পরিবেশ মানুষকে মুক্তমনা করে- এই দর্শন থেকে ৫ বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে পাঠদান করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোসা রেবেকা সুলতানা। প্রত্যেক সেমিস্টারের লাস্ট ক্লাসটি খোলা আকাশের নিচে নিয়ে থাকেন তিনি।

রবিবার (২২ জানুয়ারি) রবিবার দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে ৮৫ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে পঞ্চম সেমিস্টারের ভারতীয় দর্শন কোর্সের শেষ ক্লাসটি কলাভবনের ফোয়ারার পাশে খোলা আকাশের নিচে নিয়েছেন তিনি।

খোলা আকাশের নিচে ক্লাস নেয়ার বিষয়ে ড. রেবেকা সুলতানা বলেন, “এই ক্লাসটি নেয়ার পেছনে মূল কারণ শুধুমাত্র আমার শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করা। অর্থাৎ নতুন যুগের সাথে তারা যেন সংস্পর্শে থাকতে পারে সেজন্য ক্লাসটি নেয়া। আমরা ক্লাসে যে গতানুগতিক জিনিস পড়াই সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সে (শিক্ষার্থী) যেন পরবর্তী বছরটা কন্টিনিউ (চলমান) করতে পারে, কোন ধরনের হতাশা, অস্থিরতা বা চাপ না নেয় সেই বিষয়টা মোটিভেট (অনুপ্রেরণা) করা হয় এই ক্লাসে। মূলত তাদের মূল ক্লাস যেটা সেটা করতে গিয়ে তাদের নাভিশ্বাস উঠে যায় সেখান থেকে বের করে এনে তাদের মধ্যে একটি সুন্দর মানসিকতা তৈরি করার জন্য শেষ স্মৃতি হিসেবে তাদের এ ক্লাসটি উপহার দেয়া হয়।”

কবে থেকে কিভাবে নিচ্ছেন ক্লাসটি এ বিষয়ে দর্শন বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, “আমি ২০১৭ সাল থেকে উন্মুক্ত স্থানে ক্লাসটি নেয়া শুরু করি বিশেষ করে করোনা মহামারীর পর যখন বদ্ধ পরিবেশ থেকে উন্মুক্ত পরিবেশে ক্লাস নেয়া শুরু করি তখন আমাদের এই ক্লাসটি অনেক বেশি প্রচার পেয়েছে এবং বাচ্চারাও ক্লাসটি এনজয় (উপভোগ) করে, এটা বোঝা গেছে তাদের সাক্ষাৎকারে। এ বিষয়ে তখন ডেইলি স্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আমি নিজ থেকে ক্লাসটি নেই না অর্থাৎ বাচ্চারা আগে নিজ থেকে একটি এপ্লিকেশন দেয় যে তারা একটি উন্মুক্ত পরিবেশে ক্লাস করতে চায় এবং সেই ক্লাসটি আমাদের গতানুগতিকতার বাইরে থাকে এবং সেখানে শেখানো হয় যে সে কিভাবে জীবনের সাথে ফাইট দিবে।”

খোলা আকাশের নিচে কয়টি ক্লাস হয়ে থাকে এ বিষয়ে ড. রেবেকা বলেন, “আমাদের যেহেতু বছরে ২টা সেমিস্টার হয় ৬ মাসে মাঝে আমাদের ৪টা ছিল তখন ৪টা থাকলে অর্থাৎ যদি ৪টা সেমিস্টার হয় তাহলে ৪টা ক্লাস হয়। একেবারে প্রত্যেক সেমিস্টারের লাস্ট ক্লাসটি এরকম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তাদের জীবন সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা এবং সাথে সাথে তার সিলেবাসটিকে একটি শর্ট সিলেবাস হিসেবে দেখিয়ে দেয়া হয় যে কোনো জায়গাগুলোকে সে ফোকাস করবে যাতে সে লাইফে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।”

ক্লাস নেয়ার স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি বলেন, “প্রতিবছরই আমি জায়গা পরিবর্তন করি কারণ এক জায়গায় প্রতিবছর করলে একটা একঘেয়েমি চলে আসবে। তাই জায়গা পরিবর্তন করে ক্লাস নেই। আমি প্রথম ক্লাসটি বটতলায় নিয়েছিলাম, এরপর আরও দুটি ক্লাস বটতলায় নেই। তারপর দুটো ক্লাস চারুকলায় নিয়েছি আর আজকে অনুষ্ঠিত হয়েছে আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনে।”

ক্লাসে পাঠ্য আলোচনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক ও ভালো মানুষ হতে দিকনির্দেশনা দেন ড. রেবেকা সুলতানা। তিনি বলেন, “আমাদের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে এবং সঠিক মানুষ নির্বাচন করতে হবে। ভুল মানুষ নির্বাচন করা যাবে না। তোমাদের নিজস্ব একটি চিন্তা থাকতে হবে। ফিদেল কাস্ত্রো বলেছেন, আইডিয়া নিয়ে কেউ জন্মায় না, আইডিয়া তৈরি করতে হয়। তোমাদের আইডিয়া তৈরি করতে হবে। নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে হবে।”

দার্শনিকদের শিক্ষা পদ্ধতির সাথে উন্মুক্ত স্থানে ক্লাস নেয়ার সম্পর্কের বিষয়ে রেবেকা সুলতানা বলেন, “প্রথম কাজই হলো আমাদেরকে ফিলোসফার (দার্শনিক) যদি হতে হয় এবং ফিলোসফারের দিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে হয় তাকে অবশ্যই মুক্তমনা হতে হবে আর মুক্ত পরিবেশ ছাড়া মুক্তমনা হওয়া সম্ভব নয়। যে কারণেই এই মুক্ত জায়গায় নিয়ে আসা এবং আমরা দেখি যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তাঁরা দার্শনিক ছিলেন প্রত্যেকের কিন্তু নিজস্ব দর্শন আছে। তারপর আমরা দেখি যে রুশো তার শিক্ষা দর্শনে কিন্তু একেবারেই খোলা জায়গায় বাচ্চাদের ছেড়ে দিতে বলেছেন। আমরা দেখি যে রুশো তার এমিল গ্ৰন্থটিতে এমিলকে চরিত্র হিসেবে দেখিয়েছে কিন্তু তাকে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে বলেছে। আমরা যদি বাচ্চাদের বাইরে নিয়ে আসি তাহলে সে একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। সুতরাং দর্শন তখন তাঁর জীবন দর্শন হয়ে দাঁড়ায় এবং কার্যকরী হয়ে ওঠে। তখন সে থিওরিটিক্যাল (তাত্ত্বিক) আমাদের যে কাজকর্ম তার পরিবর্তে প্র্যাক্টিক্যালি (ব্যবহারিক) কি করতে হবে সেটা বুঝতে পারে। অর্থাৎ সে সবকিছু লালন করতে শিখে এবং সাথে সাথে সে তখন সেটা বাস্তবে নিয়ে যেতে পারে।”

ক্লাসে পাঠ্য বিষয় পড়ানোর চেয়ে মোটিভেশন বেশি দেন অনেক শিক্ষার্থী এ কথা বলে থাকেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা (মোটিভেশন) দেয়ার মূল কারণ হচ্ছে যে পাঠ্যবই তো আমরা যে কেউ পড়ে ফেলতে পারি। পাঠ্যবিষয় পড়িয়ে দেই না তা না শুধু এই ক্লাসটায় দেয়া হয় না মূল পাঠ্য বিষয় থেকে কিন্তু ক্লাসে আমি মূল পাঠ্যবই পড়াই মানে আমাদের যে কোর্স থাকে নাহলে আমাদের কোর্স তো কমপ্লিট হওয়ার কথা না‌। সুতরাং ওটা (পাঠ্যবই) ওখানে (ক্লাসে) কমপ্লিট করা হয়। যেহেতু তাকে (শিক্ষার্থী) আমরা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিতে চাই অর্থাৎ বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই সুতরাং আমাকে শুধুমাত্র সিলেবাসে আটকে থাকলে হবে না সে কারণেই তাকে এই মোটিভেশনাল স্পিচটা (অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য) দেয়া হয়।”

খোলা আকাশের নিচে এই বিশেষ ক্লাস শেষ হলে আপ্যায়ন হিসেবে মিষ্টি দেয়ার হয়। এর কারণ জানতে চাইলে ড. রেবেকা বলেন, “এটা শুধুমাত্র বাচ্চাদের চিয়ারআপের (উৎসাহিত করার) জন্য অর্থাৎ তারা আগে নিজেরাই এটা অ্যারেঞ্জ (আয়োজন) করত কিন্তু আমি যখন দেখছি যে তারা নিজেরাই বাদাম কিনে খাচ্ছে, চকলেট কিনে খাচ্ছে তখন টিচার (শিক্ষক) হিসেবে আমার তো একটা দায়িত্ব থেকেই যায় যেহেতু আমি একটা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত, আমার একটা স্যালারি আছে সেহেতু আমি তখন বাচ্চাদের চিয়ারআপের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করি।”

এমন বিশেষ পাঠদানের আয়োজন শেষে ড. রেবেকা সুলতানা শিক্ষার্থীদের শুধু একটা আহ্বানই জানান, “তোমরা তোমাদের স্বপ্নকে লালন করো এবং পৃথিবীকে জয় করো।”

Link copied!