বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ জুলফিকার আলী জানিয়েছেন, দেশে গত ১৪ বছরে ২৯ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতি ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এগুলো সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত লাইভ জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ ও সংকটাপন্ন অন্য বিপন্ন প্রজাতির সঙ্গে পুনরুৎপাদন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “গত ১৪ বছরে বিলুপ্তপ্রায় ২৯টি মাছের প্রজাতি উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটিকে আগে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি বলে মনে করা হতো।”
তিনি বলেন, “চরম বিপন্ন, বিপন্ন, ঝুঁকিপূর্ণ এবং হুমকির মুখে থাকা মিঠা পানির মাছের প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য বিএফআরআই একটি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এর লাইভ জিন ব্যাংকে এগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই মাছগুলো বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে উৎপাদন করা হবে।”
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) ২০২৫ সালের এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশের মোট মাছের ৬৪টি প্রজাতি বা ২৫.৩% “হুমকির মুখে’’ রয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৬৪টির মধ্যে নয়টি প্রজাতি “গুরুতর বিপন্ন”, ৩০টি “বিপন্ন” এবং পাঁচটি প্রজাতি “ঝুঁকিপূর্ণ”।
এর আগে ২০০০ সালের মূল্যায়নে বলা হয়েছিল, ৫৪টি মাছের প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন ও এর মধ্যে ১২টি “চরমভাবে বিপন্ন”, ২৮টি “বিপন্ন” এবং ১৪টি “ঝুঁকিপূর্ণ”।
আইইউসিএন বাংলাদেশের মোট মাছের ২৬৬টি প্রজাতির মূল্যায়ন করেছে। যার মধ্যে ১৪০টি ছোট এবং বাকি ১২৬টি আকারে বড়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হ্যাচারি বা কাছাকাছি পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য চাষ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন এবং খোলা পানিতে মাছের প্রজাতি গত কয়েক দশকে তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
২০১৫ সালে আইইউসিএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দেশের প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়ে উৎপাদিত মিঠা পানির মাছ চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত ছিল। উন্মুক্ত জলাশয়ে উৎপাদিত মাছের উৎপাদন প্রতি বছর ১.২৪% হারে হ্রাস পেয়ে এখন ৫০%-এ নেমে এসেছে।”
ফলে বেশ কয়েকটি মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির পথে এবং আরও অনেকগুলো অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএফআরআই প্রধান বলেন, “আবহাওয়ার পরিবর্তন ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের মধ্যে প্রাকৃতিক আবাসস্থল শুকিয়ে যাওয়ার কারণে কয়েক বছর ধরে কিছু মাছের জাত বিলুপ্ত হয়ে গেছে।”
রাষ্ট্র পরিচালিত গবেষণা সংস্থার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পিএসও) ড. অনুরাধা ভদ্র বলেন, “আইইউসিএন-এর তালিকাভুক্ত ৬৪টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ প্রজাতির মধ্যে ‘আমরা ৪০ প্রজাতির জার্মপ্লাজম বা জেনেটিক নমুনা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি’।”
তিনি বলেন, “বিএফআরআই স্থানীয় মাছের জাত রক্ষায় ও কৃষকদের কাছে এর প্রজনন প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে মানুষের জন্য মাছের প্রজাতির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে তাদের গবেষণাকে শক্তিশালী করেছে।”
তবে তিনি আফসোস করেন, “বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়ের কারণে কিছু মাছের প্রজাতি এখন বিলুপ্তির পথে।”
ড. ভদ্র বলেন, “লাইভ জিন ব্যাংক স্থানীয় মাছগুলোকে রক্ষা করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে যা এক সময় প্রকৃতির একটি অসাধারণ উপহার এবং খাবারের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল।”
প্রাকৃতিক উৎসে মাছের উৎপাদন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে নীলফামারীতে একটি সাব-স্টেশনসহ ময়মনসিংহে বিএফআরআই প্রধান কার্যালয়ে লাইভ জিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে।
বিএফআরআই বিজ্ঞানীরা বলেছেন, তারা দু’টি জিন ব্যাংকে ১৬২টি বিপন্ন প্রজাতির মাছের জিন সংরক্ষণ করেছেন, এরমধ্যে ১০২টি ছোট এবং দেশীয় মৎস্যসম্পদ।
বিএফআরআই-এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর মোহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, “প্রকৃতি থেকে কোনো প্রজাতি হারিয়ে গেলে, ব্যাংক সেগুলো হ্যাচারিতে প্রজনন করবে এবং প্রাকৃতিক পুনর্জন্মের জন্য উন্মুক্ত জলাশয়ে ছেড়ে দেবে।”
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সরদার অবশ্য জিন ব্যাংকের সাহায্যে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বদ্ধ পানিতে প্রজনন করা মাছ এবং উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের একই স্বাদ আশা না করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “যখন কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখীন হয় তখন জিন ব্যাংকের প্রয়োজন হয়।”
কর্মকর্তারা বলেছেন, মাছ দেশের বার্ষিক প্রোটিনের ৬০% সরবরাহ করে যেখানে মাছের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৩০-৩৫% মিঠা পানির জাতগুলো পূরণ করে।
বাংলাদেশ ২০০৯ সালে প্রায় ৬৭,০০০ টন ছোট মাছ উৎপাদন করেছিল, চাষ প্রসারের সুবাদে ২০২১ সালে তা বেড়ে ২,৬১,০০০ টন হয়েছে।
মাছ উচ্চমানের প্রোটিন, ভিটামিন “এ” ও “ডি”, ফসফরাস”, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম এবং আয়োডিনসহ বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং খনিজ সরবরাহ করে যখন এগুলো অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি মূল্যবান উৎস ও এই প্রোটিন সহজেই হজমযোগ্য।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন দশকে বাংলাদেশের মাছের উৎপাদন ছয়গুণ বেড়েছে। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে, দেশে মাত্র ৭.৫৪ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়েছিল, যেখানে ২০২০-২১ সালে এই পরিমাণ ৪৬.২১ লাখ টন ছাড়িয়েছে।
২০২০-২১ সালে, বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদের দিক থেকে বিশ্বব্যাপী তৃতীয় অবস্থানে ছিল, প্রায় ২০ মিলিয়ন টন মাছ আহরণ করে এবং দেশের জিডিপিতে ৩.৫৭% অবদান রাখে।
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী ৫০টিরও বেশি দেশে মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে আসছে, ২০২১-২২ সালে মোট ৫৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১%-এর বেশি।
দেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাছ চাষে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ মাছের চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ৪২ লাখ টন।