সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৩, ১২:০১ পিএম
একেরপর এক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে মরক্কো ও তুরস্ক। সম্প্রতি মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে ছয় দশমিক আট মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে বহু ঘরবাড়ি ও স্থাপনা। এর কয়েক মাস আগেই তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বে এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আঘাত করা দু`টি বিধ্বংসী ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল এবং আরও অনেক মানুষ আহত বা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ এসব ভূমিকম্প আঘাত করে।
কোনো স্থানে ভূকম্পনের জন্য ফল্ট লাইনের বড় ভূমিকা রয়েছে। ভূত্বকের বিশাল খণ্ডকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। আর দুটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে থাকা ফাটলকে ফল্ট লাইন বলা হয়। ফল্ট লাইন দিয়ে ২ প্লেটের সংঘর্ষ হলে ভূমিকম্প হয়।
চলতি বছরের ছয়ই ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরে সাত দশমিক আট মাত্রার ভূমিকম্পে যখন তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তের মানুষের মাথার ওপর বাড়িঘর ভেঙে পড়ছিল, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই তখন ঘুমে।
বড় কোনো দুর্যোগ আসতে যাচ্ছে এমন ইঙ্গিত সেমিওলজিস্ট বা এধরণের সংকেত নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা পান সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সংবেদনশীল যন্ত্রগুলোর মাধ্যমে।
কারণ প্রথম দফা ভূমিকম্পের ফলে তৈরি হওয়া ভূকম্পন সারা বিশ্বকে নাড়া দেয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর সাত দশমিক পাঁচ মাত্রার বড় আকারের দ্বিতীয় ভূমিকম্প আঘাত হানে।
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস কি পাওয়া সম্ভব?
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনের তত্য অনুয়ায়ী, বৈজ্ঞানিকভাবে আগে থেকেই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া খুবই কঠিন।
যদিও একটি ঘটনা ঘটে যাবার পর প্রায়শই ভূকম্পনজনিত ডেটা বা তথ্যে মিনিটের সংকেত শনাক্ত করা যায়, তবে কী অনুসন্ধান করতে হবে সেটা বোঝা এবং পূর্বাভাস দেয়ার জন্য এটি ব্যবহার করা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং।
ইতালির রোমের সেপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞানের এবং যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস ম্যারোন বলেন, "যখন আমরা পরীক্ষাগারে ভূমিকম্পের পরীক্ষা চালাই তখন আমরা এই সমস্ত ব্যর্থতা দেখি- যেখানে প্রথমে কিছু ফাটল এবং কিছু ত্রুটি দেখা যায়।"
"কিন্তু প্রকৃতিতে অনেক অনিশ্চয়তা থাকায় আমরা প্রায়শই বড় ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে এমন কোনো ইঙ্গিত পাই না।"
অন্তত ১৯৬০ সাল থেকে ভূতত্ত্ববিদরা ভূমিকম্পের আগাম বার্তা পাওয়ার জন্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা করে গেলেও, তাতে সামান্য সফলতাই পেয়েছেন।
এছাড়াও পৃথিবীর অভ্যন্তরে অনবরত সংঘর্ষের কারণে প্রচুর পরিমাণে আওয়াজ হয় এবং এটি বেশ গর্জন করতে থাকে। এগুলো আবার রাস্তার ট্র্যাফিক, নির্মাণ কাজ এবং দৈনন্দিন জীবনের কোলাহলের সাথে মিশে যাওয়ায় সেখান থেকে ভূমিকম্পের স্পষ্ট সংকেত বাছাই করা কঠিন হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুসারে, একটি সত্যিকারের ভূমিকম্পের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় জরুরি- এটি কোথায় ঘটবে, কখন ঘটবে এবং কত বড় আকারের হবে।
সংস্থাটি বলছে, এখন পর্যন্ত কেউই নিশ্চিতভাবে এটি করতে পারে না।
তার বদলে ভূতত্ত্ববিদরা তাদের সেরা অনুমান দিয়ে `প্রাকৃতিক বিপদ মানচিত্র` তৈরি করে, যেখানে তারা কয়েক বছরের সময়সীমার মধ্যে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা হিসেব করে।
এগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় তোলা দালানের মান উন্নত করার মতো পরিকল্পনায় কিছুটা সাহায্য করতে পারলেও জনসাধারণকে সরিয়ে নেয়া বা নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার মতো প্রাথমিক সতর্কতা নিতে প্রয়োজনীয় পূর্বাভাস দেয় না।
তাছাড়া ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে থাকা সব বাসিন্দার প্রচুর পরিমাণে কম্পন সহ্য করতে পারা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মানের সামর্থ্যও নেই।
তবে সম্প্রতি মানুষ যে সূক্ষ্ম সংকেত ধরতে পারে না তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শনাক্তের বিষয়ে এক ধরনের উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে।
মেশিন-লার্নিং অ্যালগরিদম বা গাণিতিক পরিভাষাগুলো অতীতের ভূমিকম্প সংশ্লিষ্ট তথ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন নমুনা অনুসন্ধান করে যা ভবিষ্যতে এসব ঘটনার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেইজিংয়ের ভূমিকম্প পূর্বাভাস ইনস্টিটিউটে জিং লিউয়ের নেতৃত্বে কাজ করা একটি দল বলেছে যে এটি ২০১০ সালের এপ্রিলে ক্যালিফোর্নিয়ার বাজাতে ভূমিকম্প আঘাত হানার ১০ দিন আগে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের উপরে বায়ুমণ্ডলীয় ইলেকট্রনগুলিতে বিশৃঙ্খলা দেখতে পায়।
ইসরায়েল ভিত্তিক আরেকটি দল সম্প্রতি দাবি করেছে যে মেশিন-লার্নিংয়ের মাধ্যমে তারা গত ২০ বছরের আয়নমন্ডলে ইলেকট্রনের পরিবর্তন পরীক্ষা করে ৮৩শতাংশ নির্ভুলতার সাথে ৪৮ ঘন্টা আগেই বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যান্য গবেষকরা বিভিন্ন সংকেতের উপর ভরসা করছেন। জাপানে কেউ কেউ পূর্বাভাসের জন্য ভূমিকম্প অঞ্চলের উপরে জলীয় বাষ্পের পরিবর্তন সম্ভব বলে দাবি করেন। পরীক্ষাগুলোতে দেখা গেছে, এই পূর্বাভাসের ৭০ শতাংশ নির্ভুল, যদিও তারা কেবল বলতে পারেন যে পরের মাসে যে কোনো সময়ে ভূমিকম্প হতে পারে। অন্যরা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে মিনিটের তরঙ্গ যা ভূমিকম্পের আগে ঘটে থাকতে পারে, সেটি ব্যবহারের চেষ্টা করছে।
কিন্তু এসব দাবি সত্ত্বেও, ভূমিকম্প হওয়ার আগে কোথায় এবং কখন হবে তা কেউই সফলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয়নি।