পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলের অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারালেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। শনিবার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮টায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরোধী দলের আনা অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটি হয়। ভোটাভুটিতে হেরে যান ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা ইমরান খান।
দিনভর নানা নাটকীয়তা শেষেও নিজের পতন ঠেকাতে পারলেন না পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। রবিবার প্রথম প্রহরে পার্লামেন্টে বিরোধী দলগুলোর আনা অনাস্থা ভোটে হেরে যান তিনি।
জাতীয় পরিষদে ৩৪২টি ভোটের মধ্যে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থার ভোট পড়েছে ১৭৪ টি। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বিপক্ষে পড়ায় আর প্রধানমন্ত্রী থাকছেন না ইমরান খান।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে গত ৩ এপ্রিল পার্লামেন্টে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। তবে সংবিধানের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি ওই প্রস্তাবকে ‘অসংবিধানিক’ উল্লেখ করে খারিজ করে দেন। পাশপাশি তিনি জাতীয় পরিষদে জানান, “বিরোধীদের আনা প্রস্তাব আসলে ‘বিদেশি চক্রান্ত’।” পরবর্তীতে ইমরান খানের পরামর্শে জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি।
তবে প্রেসিডেন্ট জাতীয় অধিবেশন ভেঙ্গে দিলেও বিরোধী দলগুলো ডেপুটি স্পিকারের অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। টানা চার দিন চরম নাটকীয়তার পর গত বৃহস্পতিবার ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব বাতিল ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেন সুপ্রিম কোর্ট। পাশাপাশি ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের আনা অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটির তারিখ শনিবার নির্ধারণ করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় সময় শনিবার সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের অধিবেশন শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর স্পিকার আসাদ কায়সার অধিবেশন মূলতবির সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় একের পর একত নাটক। বেলা ২টা ৩০ মিনিটে অধিবেশন পুনরায় শুরু হয়। পরে জানানো হয়, ইফতারের বিরতির পর রাত ৮টার দিকে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হবে। তবে মধ্যরাতেও সেই অধিবেশন শুরু হয়নি।
পরবর্তীতে ইমরান খানের অনুগত হিসেবে পরিচিত স্পিকার আসাদ কায়সার ও ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি অনাস্থা প্রস্তাবের ভোট থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে রাতেই পদত্যাগ করেন। স্পিকারের পদত্যাগের আগে অধিবেশনের সভাপতিত্বের দায়িত্ব পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এর এমপি আয়াজ সাদিকের কাছে ন্যাস্ত করেন আসাদ কায়সার। এরপরই শুরু হয় ভোট। তাতে অনাস্থার পক্ষে পড়েছে ১৭৪ জন সংসদ সদস্য ভোট দেন। আর এর মাধ্যমে পাকিস্তানের ইমরান খানের যুগের শেষ।
এক নজরে ইমরান খানের জীবন বৃত্তান্ত
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে ২২ বছরের সংগ্রামী রাজনৈতিক অতীত রয়েছে তার।ইমরান খান পাঞ্জাবের সচ্ছল পরিবারে ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি। তবে ক্রিকেট-বিশ্বে ইমরান খান নামেই খ্যাতি কুড়ান। যে কারণে পুরো নাম ঢাকা পড়ে তার।
ইমরান খানের বাবার নাম ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মা শাওকাত খানুম গৃহিণী। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তিনি। নিয়াজি বংশের এ পরিবার উত্তর পাঞ্জাবে বসবাস করত। ইমরান খানের চার বোন ছিল। ছোটবেলায় তিনি শান্ত স্বভাবের ছিলেন।
ইমরানের পরিবারে ক্রিকেটপ্রীতি ছিল। তার মামাতো ভাই জাভেদ বারকি এবং মাজিদ খান ক্রিকেট খেলতেন। ফলে, স্কুলে থাকতেই তার ভেতরে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ইমরান ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন।
শিক্ষা জীবন
মামাতো ভাইদের উৎসাহেই ইমরান খান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এবং পাকিস্তানের হয়ে খেলতে শুরু করেন। ইমরান খান লাহোরের অ্যাটকিনসন কলেজ এবং ক্যাথেড্রাল স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি অরচেস্টারের রয়েল গ্রামার স্কুলে ভর্তি হন।
১৯৭৫ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কেবলি কলেজ থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।
ক্রিকেট জগত
ইংল্যান্ডে থাকাকালেই তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে নজর কাড়েন। ১৯৭১ সালের ৩ জুন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলার মধ্য দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন। ৮৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলা ইমরান অলরাউন্ডারের খেতাব পান এবং ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথামের পর বিশ্বের দ্বিতীয় দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে রেকর্ড গড়েন।
ক্রিকইনফোর তথ্য মতে, ৮৮টি টেস্ট ম্যাচের ১২৬ ইনিংসে ব্যাট করে ৩৭.৬৯ গড়ে ৩৮০৭ রান সংগ্রহ করেছেন। যার মধ্যে সেঞ্চুরি ছয়টি, হাফ সেঞ্চুরি ১৮টি এবং সর্বোচ্চ ১৩৬ রানের ইনিংস খেলেন। টেস্টের বোলিংয়ে ৮৮ ম্যাচের ১৪২ ইনিংসে তিনি সর্বমোট ১৯৪৫৮টি বল করে ৮২৫৮ রানের বিপরীতে উইকেট নিয়েছেন ৩৬২টি। ২২.৮১ এভারেজে তার ইকোনমি হচ্ছে ২.৫৪। তার ইনিংস সেরা বোলিং হচ্ছে ৫৮ রান দিয়ে ৮ উইকেট। ম্যাচের সেরা বোলিং ফিগার হলো ১১৬ রান দিয়ে ১৪ উইকেট। ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়েছেন ৬ বার, ৫ উইকেট ২৩ এবং চার উইকেট নিয়েছে ১৭ বার।
১৯৯২ সালে তার নেতৃত্বে পাকিস্তান ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতার পরই সে বছরের ২৫ মার্চ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ক্রিকেটকে বিদায় জানান।
তার ২১ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ছিল নানা অর্জনের। ‘পাকিস্তানের প্রতিভা’, ‘পাকিস্তানের ক্যাপ্টেন’ ও ‘পাকিস্তানের ক্রিকেট জাদুকর’ এমন বিশেষণ তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আশির দশকের শুরুতে ইমরান খানকে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার মানা হতো।
রাজনৈতিক জীবন
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম ডনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইমরান খান ১৯৯৬ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) রাজনৈতিক দল গঠন করে সবাইকে চমকে দেন। খেলার মাঠ ছেড়ে রাজনীতির মাঠে নামায় তাকে নিয়ে সমালোচনা ও হাস্যরস তৈরি হয়েছিল। ক্রিকেটের অলরাউন্ডার, রাজনীতির কঠিন মারপ্যাঁচের কী জানেন তিনি এ নিয়ে তৎকালীন রাজনীতিবিদরা মিডিয়া সরগরম করে তুলেছিলেন। দল গঠনের পরের বছরই পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে দুইটি আসনে ভোট যুদ্ধে নামেন ইমরান খান। দুই আসনেই খালি হাতে ফেরেন। দলের ভরাডুবি বলতে যা বোঝায় সেটাই হলো। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশটির ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের ব্যাপক সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি। দলের পরিচিতি বাড়াতে ক্রিকেটার ইমেজটাই কাজে লাগান।
২০১৩ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ব্যাপক প্রতিবাদের ডাক দেন ইমরান। মাত্র ১৯ শতাংশ ভোট পায় ইমরানের পিটিআই। আবারও ভরাডুবি তার দলের। তবে এই হতাশাজনক ফলাফলের পর রীতিমতো পুনর্জন্ম ঘটে পিটিআই বা তেহরিক-ই-ইনসাফের।
২০১৩ সালে নির্বাচনে নিজ আসনে জয়ের পর সংসদ সদস্য হয়ে রাজনীতিতে নতুন রূপে দেখা যায় ইমরান খানকে। বিরোধী দলের ভূমিকায় নামে তার দল। সরকারের সমালোচনায় সর্বদা মুখর থাকেন তিনি। জঙ্গিবাদের প্রতি তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পাওয়ায় তীব্র সমালোচিত হন। সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থি দলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাও মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়।
ইমরান খানকে নিয়ে সমালোচনার পাহাড় থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি দিন দিন জনপ্রিয় হতে থাকেন দুইটি কারণে। প্রথমত, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান এবং দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সোচ্চার হওয়া। তরুণ সমাজের কাছে ইমরান খানের বিপুল জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে যায়।
সবশেষ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জনমত ও বুথ ফেরত সমীক্ষায় পাল্লা ভারী ছিল তেহরিক-ই-ইনসাফের পক্ষে। হয়েছেও তাই। অনকে নাটকীয়তার পর ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমরান খান।