ভারতের উত্তর প্রদেশের কৃষক মোহাম্মদ আরিফ আহত একটি সারস পাখিকে সেবাশুশ্রূষা করে ভাল করে তুলে আলোড়ন ফেলেছিলেন। কারণ সারস পাখিটি সেরে উঠার পর আর ফিরে যেতে চায়নি পাখিদের দলে। সেই পাখিটি সারাদিন বনেবাঁদারে ঘুরে সন্ধ্যার আগেই চলে আসতো তার বাড়ি। এ খবর দেশটিতে ভাইরাল হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখন সেই সারস পাখিটি জব্দ করে নিয়ে গেছে। আরও বড় কথা, পাখিটিকে আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।
সারস পাখিটি কৃষক আরিফের সাথেই বেশি থাকতো, ছেড়ে যেতে চাইতো না। ছবি: সংগৃহীত
কৃষক মোহাম্মদ আরিফ পাখিটিকে সুস্থ করে তোলার পর তাদের মধ্যে যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সে খবর সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে ওঠার পর কর্তৃপক্ষ বিরল প্রজাতির এই পাখিটিকে তাদের হেফাজতে নিয়েছে। উত্তর প্রদেশের কর্মকর্তারা সংরক্ষিত প্রজাতির সারসকে বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্যে স্থানান্তরিত করেছে।
এক বছর আগে আরিফ তার ক্ষেতে আহত পাখিটিকে খুঁজে পান। তখন বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, তিনি আশা করেছিলেন পাখিটি সুস্থ হয়ে উঠলে সে হয়ত বনে উড়ে চলে যাবে, কিন্তু সে যায়নি।
খবরে বলা হয় যে সারসটিকে অভয়ারণ্যে নিয়ে যাওয়ার একদিন পরেই পাখিটি সেখান থেকে উড়ে পালায়, যদিও অভয়ারণ্যের কর্মকর্তারা এ খবর অস্বীকার করেছেন।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম খবর দেয়, সারস পাখিটিকে খুঁজে পায় কিছু গ্রামবাসী। তারা একটি সারস পাখিকে খাওয়াচ্ছে, ভাইরাল হওয়া এমন একটি ভিডিওতে এই দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু কর্মকর্তারা এই খবর অস্বীকার করে বলেন, সারসটিকে যে সামাসপুর অভয়ারণ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল “তার চৌহদ্দির মধ্যে” সারসটি সর্বক্ষণ ছিল।
অভয়ারণ্যের কর্মকর্তা রূপেশ শ্রীবাস্তব বিবিসি হিন্দিকে জানান: “সারস পাখিটি কোন ঘরের মধ্যে আটক রাখা ছিল না। সে নিজেই বাইরে তার খাবার খুঁজে খাচ্ছিল। আমরাও তাকে গম, রুটি আর পানি দিচ্ছিলাম।”
উত্তর প্রদেশ রাজ্যে সারস পাখি আছে কম পক্ষে ১৭ হাজার। ওই রাজ্যের “জাতীয় পাখি” হল সারস। ভারতীয় আইনের অধীনে কোন ব্যক্তির সারস পাখি পোষা বা ঘরে রাখা বা এমনকি তাকে খেতে দেওয়াও বেআইনি।
কৃষক মোহাম্মদ আরিফ, যিনি গত বছর আহত সারসটিকে উদ্ধার করেছিলেন, বলছেন কর্মকর্তারা মঙ্গলবার তার বাসায় যায় এবং জানায় সারসটিকে তিনি আর নিজের কাছে রাখতে পারবেন না।
কর্মকর্তারা জানান সারসটি জব্দ করে নিয়ে যাবার জন্য বন্যপ্রাণী অধিদপ্তর তাদের আদেশ দিয়েছে, বলেন মোহাম্মদ আরিফ।
সারস পাখিটি দেখতে কৃষক আরিফের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন অখিলেশ যাদব। ছবি: সংগৃহীত
আরিফ বলেন, আমি বন্যপ্রাণী আইন বিষয়ে কিছু জানি না। আমি একজন কৃষক। কিন্তু আমি যদি পাখিটিকে খাঁচার ভেতর বন্দি করে রাখতাম, তাকে বেধে রাখতাম এবং তাকে কোথাও যেতে না দিতাম, তাহলে আমি বুঝতাম যে বন বিভাগ কেন তাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে চায়।
“কিন্তু আপনি দেখেছেন পাখিটি মুক্ত অবস্থায় থাকত, নিজের ইচ্ছায় উড়ে বেড়াত, যেখানে যেতে চাইত যেত। আপনি কি কখনও দেখেছেন যে আমি সারসটির চলাফেরা বাধাগ্রস্ত করেছি, তাকে আটকে রেখেছি?” যোগ করেন আরিফ।
এ মাসের গোড়ায় বিবিসি হিন্দি থেকে যে ভিডিও রিপোর্ট করা হয়েছিল, সেখানে মি. আরিফ ব্যাখ্যা করেছিলেন যে তিনি ভেবেছিলেন সারসটির ক্ষত সেরে গেলে, সে সুস্থ হয়ে উঠলে সে উড়ে চলে যাবে। কিন্তু পাখিটি যে যায়নি, শুধু তাই নয়, পাখিটি প্রায় কখনই তার কাছ-ছাড়া হয়নি।
আরিফ বলেন, যে গাড়িতে করে সারসটিকে সামাসপুর অভয়ারণ্যে মঙ্গলবার নিয়ে যাওয়া হয়, তিনি গোটা পথ সেই গাড়ির পেছনে পেছনে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর ওরা আমাকে তাড়িয়ে দেয়। জানি না পাখিটাকে ওরা কী অবস্থায় রেখেছে। নিশ্চয়ই ওরা ওকে বন্দি করে রেখেছে, নাহলে পাখিটা আমার কাছে ফিরে আসত।
“আমি চাই পাখিটিকে মুক্ত করে দেওয়া হোক। আমি জানি ও তাহলে আমার কাছেই ফিরে আসবে,” যোগ করেন তিনি।
পাখি নিয়ে রাজনীতি?
এই পাখির কাহিনি নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতণ্ডা। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের নেতা অখিলেশ যাদব সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণতার অভিযোগ এনেছেন।
উত্তর প্রদেশ রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা অখিলেশ যাদব বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন তিনি কৃষক আরিফের বাড়িতে সারসটিকে দেখতে যাবার পরই সরকার পাখিটিকে জব্দ করেছে। তিনি পাখিটির সাথে একটি ছবিও তুলেছিলেন।
কিন্তু এই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে রাজ্য সরকার কোন প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
কিন্তু পাখিটিকে জব্দ করার পেছনে বা কৃষক আরিফকে তার প্রাণের বন্ধুর সাহচর্য থেকে বঞ্চিত করার পেছনে কোন রাজনীতি থাকুক বা না থাকুক- বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ সমীর কুমার সিনহা, যিনি ভারতের ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টে সারস সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রধান, তিনি বলেছেন পাখিটিকে অভয়ারণ্যে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত সঠিক।
সারস পাখিটি নিয়ে সরকার রাজনীতি করছে বলে অভিযোগ করেছেন অখিলেশ। ছবি: সংগৃহীত
“সংরক্ষণ আর আবেগ দুটো আলাদা বিষয়। একটি আহত বা মুমূর্ষ পাখিকে আপনি উদ্ধার করতে পারেন, সেবা দিতে পারেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনের ধারক ও বাহকদের হাতেই তাকে তুলে দিতে হবে।”
মি. সিনহা বলছেন, সেটা না করা হলে অন্যরাও বন্য পশুপাখিকে পোষা প্রাণী হিসাবে রাখতে উৎসাহিত হবে।
জলাভূমিই সারসের আদর্শ আবাসস্থল, অথচ উত্তর প্রদেশে জলাভূমি বুজিয়ে নানা প্রকল্পের কাজ চলছে - সাইফাইতে বিমান অবতরণ ক্ষেত্রের জন্য জলাভূমি বোজানোর কাজ চলছে।
উত্তর প্রদেশের 'জাতীয় পাখি' সারস বিপন্ন
সারস পাখি উড়ন্ত পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘদেহী। তারা উচ্চতায় ছয় ফুট (১.৮ মিটার) পর্যন্ত হয়। উত্তর প্রদেশের জলাভূমি তাদের আদর্শ বাসস্থান ও সেখানে তাদের বংশবৃদ্ধি হয়। ভারতের মধ্যে উত্তর প্রদেশেই সর্বাধিক সংখ্যক সারস পাখির বাস।
মি. সিনহা বলছেন, একসময় ভারতে সারস পাখিদের আবাসভূমি ছিল দেশটির পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু করে পুরো গাঙ্গেয় সমতলভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন তাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। সারস এখন দেখা যায় শুধু মাত্র রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ আর বিহারের সামান্য কিছু এলাকায়।
ভারতের ওয়ার্ল্ডলাইফ ট্রাস্ট (ডাব্লিউটিআই) উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে রাজ্যের জলাভূমি বাঁচানোর লক্ষ্যে।
তারা ক্ষেতখামারগুলো এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গেও কাজ করছে যাতে সারস পাখির বাসা তারা নষ্ট করে না ফেলে। কারণ সারস পাখি প্রায়শই তাদের ক্ষেতের ভেতর ঢুকে ডিম পাড়ে।
সমীর কুমার সিনহা বলেন, সারস প্রজাতিকে যদি আপনি সত্যিই বাঁচাতে চান, তাহলে সঠিক কাজ হবে জলাভূমিগুলো বাঁচানো। কারণ এসব জলাভূমিই সারস পাখির বাসস্থান। এগুলো বাঁচাতে পারলে প্রকৃতি তান নিজস্ব নিয়মে এই প্রজাতিকে রক্ষা করবে।