ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী সাঈদ ইব্রাহিম রাইসি দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র। এবারের নির্বাচনের জন্য মাহমুদ আহমেদি নেজাদের মতো কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকেও অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতার অনুমোদন পাওয়া সাতজনের মধ্যে বাকি তিনজনও সরে দাঁড়ায়। শেষ চার প্রার্থীর মধ্যে তিনজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক ফলা ঘোষণার আগেই পরাজয় স্বীকার করেন।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ইরানের এই নির্বাচনকে লোক দেখানো হিসাবেই দেখছে। দেশটির সরকারি হিসাবমতে, ৫১ শতাংশ নাগরিক নির্বাচনে ভোটই দেয়নি। যারা দিয়েছেন,তাদের মধ্যেও ৪০ লাখ ভোটার ফাঁকা ব্যালট জমা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে যেসব ভোট পড়েছে সেগুলোও জাল ভোট।
কিন্তু রাইসির উত্থানের ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে, তা নিয়েই ব্যাপক জল্পনা চলছে।
খোমেনির ক্ষমতা আরো সুসংহত
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে প্রথম কয়েক বছর ছাড়া বাকি সব নির্বাচন ছিল সুপরিকল্পিত। সাংবিধানিকভাবে প্রজাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা আসলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার হাতেই রয়েছে। সুতরাং এটি শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল না, পরবর্তী সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কে হবেন, তারও নির্বাচন ছিল এটি। খোমেনির বয়স এখন ৮২, দীর্ঘদিন ধরে প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, পরবর্তী শীর্ষ নেতা হবেন খোমেনির ছেলে মোজতবা। এভাবেই পদটিকে বংশানুক্রমিক করে তোলা হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন রাইসি হবেন এমন এক প্রেসিডেন্ট, যিনি মোজতবার উত্থানকে নির্বিঘ্ন করবেন।
রাইসি শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় এবং দেশের গণতন্ত্রপন্থি ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কঠোর সমালোচক। আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং রাইসির জন্ম একই স্থানে হওয়ায় স্বভাবতই সম্পর্কটা ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে।
আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দেশটিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্রপন্থিরা, যারা ইসলামী কট্টর সরকারের বিরোধী। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার কারণে শত শত গণতন্ত্রপন্থিকে গ্রেফতার করা হয় এবং তেহরানের রেভ্যুলুশনারি আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারকাজের পরই তাদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। সে সময় রেভ্যুলুশনারি আদালতের প্রধান বিচারক ছিলেন রাইসি। আর ওই বিচার প্রক্রিয়ার পরই খোমেনির আস্থাভাজন হিসেবে হিসেবে উত্থান ঘটে তার।
তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধেরও সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। প্রায় তিন দশক আগে চার হাজার ভিন্নমতাবলম্বী মানুষকে হত্যায় তার ভূমিকা রয়েছে এমন অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। রাইসির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তদন্ত করার জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইতিমধ্যে আহ্বান জানিয়েছে।
ইরানের রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী রেজা ইশরাঘি দেশটির সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে ‘ফরেন রিলেশনস’ সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইরানের রাজনীতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশটির গণতন্ত্রপন্থিদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব নতুনমাত্রা পাবে।’
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের উদ্বেগ বেড়েছে
ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও পরমাণু অস্ত্র গবেষণা নিয়ে মার্কিন উদ্বেগ সকলের জানা। যুক্তরাষ্ট্র তার মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ইরানের আধিপত্য কমাতে চায়। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে বন্ধুপ্রতিম ইসরাইলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ একটু বেশিই।
এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় একাধিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইরোনের বিরুদ্ধে। এই মুহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যুদ্ধক্ষেত্রে সিরিয়াতে বাশার আল আসাদ সরকোরের পক্ষে জোড়ালো অবস্থান রয়েছে ইরানের। আসাদবিরোধী মিলিশিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শিয়াপন্থী গেরিলাতের মদদ দিচ্ছে তারা। শুধু তাই নয়, সিরিয়ার শিয়াপন্থী বিদ্রোহীরা ইসরায়েলেকেও তাদের লক্ষবস্তু বানায়। অন্যদিকে ইরাকের একটি অংশেও ইরান সমর্থিত অস্ত্রধারীরা সক্রিয় রয়েছেন। কাশেম সোলাইমানির তাদের তদারকি করতে গিয়ে মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। লেবাননের হিজবুল্লাহও তেহরানের মিত্র। ইয়েমেনেও যুদ্ধেও তেহরান তার অবস্থান নিয়ে রয়েছে। এসব মিলিশিয়া গোষ্ঠীর দিন দিন শক্তিশালী হওয়াটা অবশ্যই উদ্বেগের। বিষয়টা হচ্ছে, ইরানের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ নেতার রসায়ন যত বাড়বে বিদ্রোহীরা ততো মদদ পাবে। প্রেসিডেন্ট রাইসি ভবিষ্যতে সেই কাজটিই করবেন। আর এতেই পশ্চিমাদের যত উদ্বেগ।
মূলত ইরান এসব মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ক্ষমতা আরও সুসংহত করছে। ইরানের ক্ষমতা না কমলে মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় এসব মিলিশিয়া গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা। ইরাকে যত কট্টরপন্থী সরকার আসবে, মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে বিলোপ করা ততই কষ্টসাধ্য। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের অন্যতম মিত্র সুন্নিপন্থী রাষ্ট্র সৌদি আরবের বিপরীতে শিয়াপন্থী ইরান ক্ষমতাশালী হোক- তা তারা চায় না।
ফলে ইরাক,সিরিয়া,লেবানন, ইয়েমেন ও সৌদি আরবের মতো বিভিন্ন মিত্রদের চাপেই যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে তৎপরতা এত বেশি।
পরমাণু চুক্তির ভবিষ্যৎ দোলাচলে
হাসান রুহানির চেয়ে ইব্রাহিম রাইসি সরকার আরও বেশি গোড়াঁ ও জাতীয়তাবাদী। রাইসি প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তাই স্বভাবতই মার্কিন নীতি- নির্ধারকদের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।
ইরানে ইব্রাহিম রাইসির বিজয়ে বাইডেন প্রশাসনেরও বেশ কিছু নিয়ম-নীতির পালাবদলের কারন হতে পারে।
ইরানের কাছে পরমাণু চুক্তি ইস্যুটি দরকষাকষির বড় অস্ত্র। করোনা মহামারিতে মার্কিন অবরোধের ফলে চিকিৎসাখাতসহ অর্থনৈতিক অনেক খাতে বেশ বিপাকে পড়ে রয়েছে। তাই তারা চায়, ওয়াশিংটন অবরোধ প্রত্যাহার করে চুক্তিতে ফিরুক।
পর্যবেক্ষরা বলছেন, ভিয়েনায় ছয়জাতি পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসা সংক্রান্ত আলোচনায় ওয়াশিংটন ও তেহরান অনেকটাএকমত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরমাণু চুক্তি থেকে সরে এসে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ইরানও পরমাণু গবেষণা জোরদার করে। সে সময় রাইসি নিজে একজন বিচারক থাকায়, পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে খোমেনি দ্রুততম সময়ে পরমাণু চুক্তি সংক্রান্ত জটিলতা শেষ করার আাহ্বান জানান ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্দেশে।
রাইসি প্রথমে খোমেনির এ সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানোর কথা বললেও প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তেহরানের পরিচালিত ব্যালেস্টিক মিসাইল সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে মার্কিন শাসকদের সঙ্গে তিনি কোনও রকম আপোষ করবেন না। বাইডেনের মনগড়া আলোচনার সঙ্গেও সে একমত নয়। কাজেই রাইসি অনেক কিছুতে শক্ত অভিমত নিয়ে হাজির হবেন- তা স্পষ্ট।
তবে এসবের মধ্যেও কিছু বিষয় রয়েছে যা প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। অনাবৃষ্টি, কোভিড-১৯, ধসে পড়া অর্থনীতি, বর্ণবাদ বিলোপের দাবিতে নারী আন্দোলন, তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ইত্যাদি বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যার কারণে দেশের নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। সবমিলিয়ে ইরানও যে এখন প্রবল চাপের মধ্যে রয়েছে।
এরমধ্যে উত্তরোত্তর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ইরানের পরিস্থিতি আরও বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে শীঘ্রই ইরানে গৃহযুদ্ধ বাধতে পারে, তাও অনেকটা ধারণা করা যায়। এ অবস্থায় ইরানও চুক্তিতে ফিরতে আগ্রহী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও মিত্রদের নিরাপত্তার স্বার্থে ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহী। তাই মার্কিন বিশেষজ্ঞরা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মধ্যবর্তী করে ইরানের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়নে তৎপর।
সূত্র : বিবিসি, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ডয়চে ভেলে।