ভোটের জন্যই কী পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতি?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪, ০৭:১৫ পিএম

ভোটের জন্যই কী পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতি?

ছবি: সংগৃহীত

‘পশ্চিমবঙ্গে ভোটের জন্য এই ধর্মীয় রাজনীতি?’ –শিরোনামে প্রতিবেদন করেছে ডিডব্লিউ বাংলা।  

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ভোট এলেই পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় রাজনীতির অভিযোগ ওঠে। তবে তা ওঠে মূলত বিজেপি-র বিরুদ্ধে। কিন্তু সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও কংগ্রেসের কয়েকজন নেতা এমন বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, তারপর প্রশ্ন উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গেও সব দলের নেতারা কি ধর্মীয় রাজনীতির দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়ছেন?

কী বলেছেন ফিরহাদ হাকিম?

সম্প্রতি রাজ্যের মন্ত্রী, কলকাতার মেয়র এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ নেতা ফিরহাদ হাকিম একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছেন, “আমরা এমন একটা সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা পশ্চিমবঙ্গে ৩৩ শতাংশ থাকলেও সারা ভারতে মাত্র ১৭ শতাংশ আছে। তাই আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলা হয়। কিন্তু আমরা আমাদের সংখ্যালঘু বলে ভাবি না। আমরা একদিন সংখ্যাগুরুর থেকেও সংখ্যাগুরু হতে পারি। আমাদের সামর্থ্যকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যে, আপনি নিজেই ন্যায় দিতে পারবেন। ন্যায় চাওয়ার দরকার হবে না।”

ফিরহাদ হাকিমের এই মন্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়। সংবাদমাধ্যমে তার এই কথা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-সহ অন্যরা তাদের মতামত জানাতে থাকেন। ফিরহাদ প্রশ্নবিদ্ধ হন।

তখন ফিরহাদ বলেন, ‘‘আমি পুরোদস্তুর ভারতীয়। আমি সাম্প্রদায়িক কথা বলিনি। বিজেপি সাম্প্রদায়িক তাস খেলার চেষ্টা করছে। তারা আমার মন্তব্যের অপব্যাখ্যা করছে।”

ফিরহাদের মেয়ে প্রিয়দর্শিনী হাকিম বলেছেন, ‘‘এমন কিছু বলা হয়নি, যার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা এনে নোংরামি করতে হবে। তবে এটা বিজেপির স্বভাব। আমাদের সকলের মাতৃভাষা বাংলা। ওই অনুষ্ঠানে উর্দুতে বলায় বিষয়টা একটু গুলিয়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”

তৃণমূলের বক্তব্য     

ফিরহাদের এই মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক শুরুর পর তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, “ফিরহাদ যা বলেছেন, তা আমি পুরোপুরি শুনিনি। একটা বাক্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক নয়। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সব ধর্মকে আমরা সম্মান করি। উনি শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এটাই মূল স্পিরিট। বিরোধীরা যা বলছে, তা ঠিক নয়। ফিরহাদ হাকিম মূলত একজন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ।”

বিতর্ক তীব্র হওয়ার পর দলের তরফ থেকে বলা হয়, ফিরহাদের এই বক্তব্য তারা অনুমোদন করে না। দলের তরফ থেকে সামাজিক মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেস ফিরহাদ হাকিমের এই মন্তব্যের নিন্দা করে। তারা এই মন্তব্য থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। তার এই মন্তব্যে দলের মতাদর্শের সঙ্গে মেলে না।

অধীর রঞ্জন চৌধুরীর বিতর্কিত মন্তব্য

কংগ্রেস নেতা, লোকসভায় দলের সাবেক সাংসদ অধীর র়ঞ্জন চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, “আগামীদিনে ওরা চাইবে এক্সটেনডেড বাংলাদেশ। কারণ, ওরা ভুগোল বাড়াতে চাইবে। ওরা মুর্শিদাবাদকে দাবি করবে। মালদহকে দাবি করবে। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা। আগামী দিনে ওরা বলতে পারে, মুর্শিদাবাদে ৭০ শতাংশ মুসলমান, অতএব এটা এক্সটেনডেড বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয়েছিল, তার দুই দিন পর মুর্শিদাবাদ স্বাধীন হয়েছিল। মালদহ, দিনাজপুরও ডিম্যান্ড করবে বাংলাদেশ।”

অধীর বলেছেন, “আগামী দিনে এই সব জেলাতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মৌলবাদীদের প্রভাব, প্রতিপত্তি বাড়বে। আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। ঠুনকো রাজনীতি করলে পশ্চিমবঙ্গ শেয হয়ে যাবে।”

সিপিএম সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “এ সব অবান্তর, অযৌক্তিক কথা। মৌলবাদের বিরুদ্ধে বামপন্থিরা লড়াই চালাচ্ছে। তা যে কোনো ধরনের মৌলবাদ হোক। অধীরবাবু একটু হতাশার সঙ্গে এই কথা বলেছেন, যার কোনো ভিত্তি নেই।”

পশ্চিমবঙ্গ, ধর্মীয় রাজনীতি এবং ভোট

প্রবীণ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান ডিডাব্লিউকে বলেছেন, “এই যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, তা পুরোটাই ভোটের জন্য। যে নেতারা এই বিতর্কিত কথা বলছেন, তারা ভোটের রাজনীতি করছেন।”

আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, “আমি ২০০৫ সালে সোনিয়া গান্ধীকে দলের বৈঠকে বলেছি, কংগ্রেস রাজ্য থেকে যে ছয়টি আসনে জেতে, সেগুলি হলো মুসলিম, তফসিলি জাতি ও জনজতি প্রধান এলাকা। অথচ, দলের নেতৃত্বে মুসলিম, দলিত, জনজাতিদের নিয়ে আসা হচ্ছে না। তখন বলা হলো, আমি নাকি পদ পাওয়ার জন্য এই কথা বলছি। এতে আমি খুবই ব্যথিত হই।”

আব্দুল মান্নানের সঙ্গে এই বিষয়ে একমত হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক মিলন দত্ত। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, “আড়াইশ কোটি টাকা দিয়ে দিঘায় জগন্নাথ মন্দির করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। না করলে হয়ত হিন্দু ভোট পাবেন না বলে বলে তার মনে হয়েছে। এখন মুসলিমদের কাছে কী জবাবদিহি দেবেন তারা। তাই হয়ত এভাবে বলানো হলো।”

মিলন বলেছেন, “অধীরের কাছ থেকে তো এরকম কথা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু এমন একজন গত লোকসভা ভোটে অধীরকে হারিয়েছেন, সেই ইউসুফ পাঠান বহরমপুরে থাকেন না পর্যন্ত। অধীরের মনে হয়েছে, তিনি আর মুসলিম ভোট পাবেন না। তাই তিনি হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে চান।”

তাহলে পশ্চিমবঙ্গেও কি দলগুলি ধর্মীয় রাজনীতির দিকে ঝুঁকবে? মিলন বলছেন, “আগেও পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতি ছিল, তবে তার সুর নরম ছিল। কিন্তু এখন সবাই দেখছে, এই পথে হেঁটে বিজেপি-র লাভ হচ্ছে, তৃণমূলের লাভ হচ্ছে, তখন সকলে সেই রাস্তায় চলতে পারে, তখন সুর চড়ছে।”

প্রবীণ সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, তৃণমূল জানিয়েছে, ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্যের সঙ্গে তারা একমত নয়। কিন্তু তারা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের বিরোধিতা করেনি। তিনি বলেছেন, মুসলিমরা যেখানে নামাজ পড়বেন, সেই জায়গাটা ওয়াকফ সম্পত্তি হয়ে যাবে।

দীপ্তেন্দ্র মনে করেন, “সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এটা একটা স্ট্র্যাটেজি।”

মিলন মনে করছেন, “এটা সাময়িক ঘটনা নয়। এখান থেকে সরে এসে রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন জায়গায় বের করে আনা এখন অসম্ভব।”

মান্নানও জানাচ্ছেন, “ভোটের রাজনীতি ভয়ংকর জায়গায় চলে গেছে।”

Link copied!