ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ: হাজারো মৃত্যুর কারণ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

অক্টোবর ৯, ২০২৩, ০৯:০২ এএম

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ: হাজারো মৃত্যুর কারণ

ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের রকেট হামলার ৪০ ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এই হামলা যে যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে তাতে প্রাণ হারিয়েছে ১ হাজার ১৩৩ জনেরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে ৭০০ জন ইসরায়েলের। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্তত ১০০ ইসরায়েলিকে অপহরণ করেছে হামাস।

এদিকে হামলার প্রতিশোধ নিতে গাজায় বিরামহীন আক্রমণ চালিয়েছে ইহুদিবাদী দেশটি। এতে অন্তত ৪১৩ জন নিহত ও ২ হাজার ৩০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গতকাল এক পরিবারের ২২ জন মারা গেছেন। গাজায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ২০ শিশুও রয়েছে।

শনিবার ভোরে গাজা থেকে জল, স্থল ও আকাশপথে ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। অন্তত ১ হাজার হামাস যোদ্ধা ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন স্থানে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। এদিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বিভাগের (আইডিএফ) দাবি, হামলা চালাতে যাওয়া হামাসের ৪০০ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে তারা। হামাসের হামলায় অন্তত ৪৪ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২ হাজার ১৫৬ জন।

পরদিনর বিবার আনুষ্ঠানিকভাবে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরায়েল সরকার। দেশটির মৌলিক আইনের ৪০ ধারা অনুযায়ী যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইসরায়েলের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। তবে এর ১৩টি মৌলিক আইন সংবিধান হিসেবে কাজ করে। ১৭ বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজায় আবারও অভিযান চালানোর ইঙ্গিত দিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তাঁর দেশ কঠিন এবং দীর্ঘ লড়াইয়ে নেমেছে।

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ এবং কঠিন যুদ্ধের সূত্রপাত হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘হামাসের ভয়াবহ আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়েছে এবং লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত কোনো দ্বিধা ও অবকাশ ছাড়াই আক্রমণ চলবে। আমরা ইসরায়েলের নাগরিকদের নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেব এবং আমরা জিতব।’ তিনি গাজার বাসিন্দাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, এ উপত্যকাকে ‘নির্জন দ্বীপে’ পরিণত করা হবে।

ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ইসরায়েলি হামলায় দক্ষিণে রাফাহ থেকে উত্তরে বেইট হানুন (ইসরায়েলিদের কাছে এরেজ নামে পরিচিত) এলাকা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি শহরে বাড়িঘর ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে বহু মানুষ। ইসরায়েল বলেছে, তাদের বাহিনী গাজা উপত্যকায় হামাসের গোয়েন্দাপ্রধানের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে।

হামাসের বিরুদ্ধে হামলার সময় ইসরায়েলের সেনাবাহিনী তাদের সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করবে এবং হামলার ফল প্রকাশ করা হবে হুমকি দিয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী তাদের সক্ষমতার পুরোটা দিয়ে হামলা করছে এবং সামনেও তারা সেটাই করবে।

গাজায় অনেক পরিবার ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। গাজার অন্তত ২০ হাজার বাসিন্দা জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলগুলোয় আশ্রয় নিয়েছেন।

আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি জায়গায় হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর তীব্র লড়াই চলছে। হামাস নেতারা বলেছেন, ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামে এ অভিযানের লক্ষ্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জন। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েক বছর ধরে এর প্রস্তুতি নেয় হামাস।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেক ইসরায়েলিকে বন্দি করে রাখার কথা জানিয়েছে হামাস।

হামাসের রাজনৈতিক শাখার উপপ্রধান সালেহ আল-আরোরি আলজাজিরাকে বলেন, এসব বন্দিবিনিময়ে হামাস ইসরায়েলের কারাগারে থাকা সব ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করতে পারবে। হামাস অনেক ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ ও হত্যা করেছে বলেও জানান তিনি। কতজনকে ধরে নিয়ে গেছে, সেই সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। তাদের গাজার টানেলসহ বিভিন্ন স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। 

ইসরায়েল সরকার বলেছে, ১০০ জনকে অপহরণ করেছে হামাস। তাদের মধ্যে সেনাসদস্যও রয়েছে।

এদিকে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় ঘুরতে যাওয়া ইসরায়েলের পর্যটকের একটি বাসে গতকাল হামলা চালিয়েছে দেশটির একজন পুলিশ কর্মকর্তা। এতে দুই ইসরায়েলি এবং তাদের গাইড নিহত হয়েছেন।

যুদ্ধের দামামার মধ্যে ইসরায়েল অধিকৃত লেবাননের শেবা খামারের তিন অবস্থানে আক্রমণ চালিয়েছে লেবাননের ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। এই হামলায় বিপুল পরিমাণ কামানের গোলা ও গাইডেড (সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম) ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানায় সংগঠনটি।

শনিবার হিজবুল্লাহ অপর এক বিবৃতিতে জানায়, তারা গাজার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ‘ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ’ রাখছে। হিজবুল্লাহ বলেছে, তাদের বন্দুক ও রকেট হামাস চাইলেই পাবে।

ইসরায়েলি প্রভাবশালী পত্রিকা হারেৎজ বলেছে, চলমান সংঘাতে হিজবুল্লাহর জড়িত হওয়াটা ইসরায়েলের জন্য আরও সংকট তৈরি করবে।

২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েল ৩৪ দিনের যুদ্ধ করেছিল। এতে লেবাননের ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি নিহত হন, যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। অন্যদিকে ১৬০ জন ইসরায়েলি মারা যায়, যাদের বেশির ভাগই সৈন্য ছিল। এ যুদ্ধকে ইসরায়েলের পরাজয় হিসেবে দেখা হয়।

ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তিনি হামাসের অভিযানের প্রশংসা করেছেন। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এ খবর দিয়েছে। দুটি সংগঠনকেই পৃষ্ঠপোষকতা দেয় ইরান সরকার।

এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। হামাসের হাতে অপহৃতদের মধ্যেও মার্কিন নাগরিকরা রয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের সাথে  ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ভেস্তে যেতে পারে।

সংঘাতে মাত্রাতিরিক্ত ও নির্বিচারে বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সশস্ত্র সংঘাতের নিন্দা জানিয়েছে এবং এর ফলে নিরপরাধ বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ও হতাহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে। শুধু সংলাপ ও কূটনীতিই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের স্থায়ী সমাধান ঘটাতে পারে বলে পুনর্ব্যক্ত করে বাংলাদেশ এ লক্ষ্যে কাজ করার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংঘাত ও সহিংসতা বৃদ্ধির ফলে কোনো পক্ষই লাভবান হবে না বলেও উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্ক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেছেন, জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এখন অপরিহার্য।

বেইজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের বর্তমান উত্তেজনা ও সহিংসতা বৃদ্ধির ঘটনায় চীন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শান্ত থাকার, সংযম চর্চার আহ্বান জানাই। পাশাপাশি বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় এবং পরিস্থিতির যাতে আরও অবনতি না ঘটে, সে জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, সংঘাতের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, শান্তি প্রক্রিয়ার দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা চলতে পারে না। দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বাস্তবায়ন এবং ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার মূল উপায়।

Link copied!