ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪, ০৭:১৮ পিএম
‘এক দেশ এক ভোট’ বিল লোকসভায় পেশের পর সংসদীয় কমিটিতে পাঠাতে চায় সরকার। তবে এই বিল পাস হওয়া নিয়ে সংশয় আছে।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘এক দেশ এক ভোট’-এর কথা বলছেন। ১০ বছর পর সেই বিল মঙ্গলবার লোকসভায় পেশ করলো সরকার। কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল, ডিএমকে-সহ বিরোধীরা এই বিল পেশেরই বিরোধিতা করে। বিল পেশ করা হবে কিনা তা নিয়ে ভোটাভুটি হয়। বিল পেশের পক্ষে ভোট দেন ২৬৯ জন, বিপক্ষে ছিলেন ১৯৮ জন।
বিল পেশের পর সরকার জানায়, বিলটি তারা যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠাতে চায়। কমিটিতে প্রায় সব দলের সদস্য থাকবেন। তারা বিলটি নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করে রিপোর্ট দেবেন। সেই সুপারিশ মেনে বিলে পরিবর্তন করতে পারে সরকার।
কী বলা হয়েছে বিলে
মঙ্গলবার লোকসভায় দুইটি বিল পেশ করা হয়। দুইটিই সংবিধান সংশোধন বিল। সংবিধানের ১২৯তম সংশোধন বিল এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আইন সংশোধন বিল।
এই দুই বিলে বলা হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে লোকসভা এবং সব রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে হবে। পরবর্তী পর্যায়ে পুরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনও লোকসভা ও বিধানসভার সঙ্গেই হবে।
বিল আইনে পরিণত হওয়ার পর যে দিন নতুন লোকসভা গঠিত হবে, তাকে বলা হবে ‘অ্যাপয়েন্টেড ডেট’। তারপর পাঁচ বছর ধরে নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নেবে এবং একসঙ্গে লোকসভা ও সব রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন করাবে। সেক্ষেত্রে ২০২৯ সালে লোকসভা গঠিত হওয়ার দিনটি হবে অ্যাপয়েন্টেড ডেট এবং তার পাঁচ বছর পর ২০৩৪ সালে একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হবে।
২০২৯ সালে বা তারপর রাজ্য বিধানসভার যে নির্বাচন হবে, তার মেয়াদ হবে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত। কারণ, ওই বছর লোকসভার সঙ্গে সব রাজ্য বিধানসভার ভোট হবে। সেক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি রাজ্যে যেখানে পরে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা, তাদের মেয়াদ ছোট হয়ে যাবে এবং সব বিধানসভার নির্বাচন হবে ২০৩৪ সালে, লোকসভার সঙ্গে।
কোনো কারণে সরকার পড়ে গেলে, অনাস্থা প্রস্তাবে সরকারের পতন হলে নতুন নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচনের পর যে সরকার হবে, তার মেয়াদ পূর্বনির্ধারিত সময় পর্যন্তই হবে। ধরে নেয়া যাক, ২০৩৪ সালে একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হলো। তার দুই বছর পর কোনো রাজ্যে সরকার পড়ে গেলো। তখন সেই রাজ্যে ভোট হবে। নতুন সরকার গঠিত হবে। তবে তার মেয়াদ ২০৩৯ সাল পর্যন্তই হবে। ২০৩৯ সালে আবার লোকসভার সঙ্গে সব রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন হবে।
কেন একসঙ্গে ভোট?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির দাবি, এখন প্রতিবছরই কোনো না কোনো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়। একেক সময়ে একেক রাজ্যের নির্বাচন করতে প্রচুর খরচ হয়। নির্বাচন হলে তার আগে আদর্শ আচরণবিধি চালু হয়ে যায়। তখন কোনো উন্নয়নমূলক কাজের ঘোষণা করা যায় না।
একসঙ্গে পুরো দেশে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা ভোট করলে খরচ অনেকটাই বাঁচবে। প্রতিবছর নির্বাচনের কাজে সরকারি দপ্তর ও নির্বাচন কমিশনকে ব্যস্ত থাকতে হবে না।
কেন বিরোধিতা?
কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, এআইএমআইএম-সহ বিরোধী দলগুলি এই বিলের বিরোধিতা করছে। তাদের দাবি, এই বিল আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত হানবে। লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনকে মিলিয়ে ফেললে চলবে না।
তাদের দাবি, সংবিধান প্রণেতারা কখনই এরকম কোনো ব্যবস্থার কথা বলেননি। তারা যা ব্যবস্থা করেছিলেন, বিলে তা বদলে দেয়া হচ্ছে।
কংগ্রেস নেতা মনীশ তিওয়ারি বলেছেন, “কী করে বিধানসভার মেয়াদ, লোকসভার উপর নির্ভর করবে? ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী এটা হতে পারে না। ভারত হলো ইউনিয়ন অফ স্টেটস। কেন্দ্রের উপর নির্ভরতা সংবিধানের বিরোধী।”
আপ নেতা ও দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দাবি, “বিজেপি ভুল জায়গায় গুরুত্ব দিচ্ছে। এক দেশ এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হওয়া উচিত।”
সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব বলেছেন, “গণতন্ত্র একের শাসন নয়, বহুর। এখানে একের স্থান নেই। ‘এক দেশ, এক ভোট’ তাই গণতন্ত্রবিরোধী। এক হলো স্বৈরতন্ত্রের কথা।”’
উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনার নেত্রী প্রিয়াংকা চতুর্বেদীর মতে, “ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করার মনসা নিয়ে এই বিল আনা হয়েছে। এই বিল সংবিধানবিরোধী।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় বলেছেন, “এই বিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করবে।”
কেন এখন এই বিল আনা হলো?
এখন এই বিল আনা হলেও ২০৩৪ সালের আগে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ ব্যবস্থা চালু হচ্ছে না। তাহলে এখনই এই বিল আনার কি দরকার ছিল?
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও ভোট-বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, “এক দেশ, এক ভোটের সঙ্গে বিজেপির মূল জাতীয়তাবাদী ভাবনার মিল আছে। তাই নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করছেন। কোনো সন্দেহ নেই, এই ব্যবস্থা চালু করলে টাকা বাঁচবে, বারবার আদর্শ আচরণবিধি চালুর হাত থেকে প্রশাসন বাঁচবে।”
তবে বিশ্বনাথ মনে করেন, “এগুলি হলো, অতিরিক্ত যুক্তি। আসল যুক্তি হলো, এক দেশ, এক ভোট সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপির জাতীয়তাবাদী ভাবনার প্রকাশ ঘটাচ্ছে বলে তারা এর উপর এত গুরুত্ব দিচ্ছে।”
প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত ভট্টাচার্য আবার মনে করেন, “এটা হলো, নরেন্দ্র মোদির ‘যা বলেছি, তা করে দেখাচ্ছি’ ভাবনার অঙ্গ। এটা এমন একটা বিষয় যা সাধারণ মানুষ সমর্থন করবে বলে বিজেপির শীর্ষ নেতারা মনে করেন।”
কিন্তু কংগ্রেসসহ বিরোধী নেতারা অভিযোগ করছেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মোদি সরকার চাপের মধ্যে আছে। তাই জনতার নজর সেদিক থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তারা এই সময়ে ‘এক দেশ এক ভোট’ বিল নিয়ে এসেছে।
কংগ্রেস নেতা নারায়ণস্বামীর অভিযোগ, “মোদী সরকার নিজের ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য লোকের দৃষ্টি ঘোরাতে চাইছে।”
পা়ঞ্জাবের সাংসদরা অভিযোগ করছেন, কৃষকদের আন্দোলন থেকে নজর সরাতে এই বিল আনা হয়েছে।
প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, “বিরোধীরা এখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারকে কোণঠাসা করতে চাইছে। সরকারও সেই সময় এই বিল এনে বিরোধীদের পিছনের পায়ে ঠেলতে চায়। তারা দেখাতে চায়, সরকার নির্বাচনী সংস্কার করতে চায়। তারা অযথা বিপুল খরচ কমাতে চায়। আর বিরোধীরা তাতে বাধা দিচ্ছে।”
বিল পাস হবে?
এত বিরোধ, বিতর্কের পর যে বিল আনা হয়ছে তা কি পাস করাতে পারবে সরকার? এই প্রশ্নটা উঠছে এই কারণে, এই বিল পাস করাতে গেলে লোকসভা ও রাজ্যসভায় দুই তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থন দরকার। কারণ, দুইটি বিলই সংবিধান সংশোধন বিল।
কিন্তু সরকারের কাছে লোকসভা বা রাজ্যসভা কোথাও দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এদিন বিল পেশের পক্ষে এনডিএ’র ২৬৯ জন সাংসদ ভোট দিয়েছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন ১৯৮ জন। লোকসভায় এনডিএ’র সাংসদ সংখ্যা ২৯৩ জন, যা দুই তৃতীয়াংশের থেকে অনেকটাই কম।
২৪৫ সদস্যের রাজ্যসভায় এনডিএ’র সদস্যসংখ্যা হলো ১২৫ জন। ফলে রাজ্যসভাতেও তাদের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন নেই।
কংগ্রেস নেতা শশী থারুর এএনআইকে বলেছেন, “লোকসভা ও রাজ্যসভায় সরকারের শক্তি আমাদের থেকে বেশি। তাই যৌথ সংসদীয় কমিটিতেও তাদের সদস্যসংখ্যা আমাদের থেকে বেশি হবে। কিন্তু সংবিধান সংশোধন বিল পাস করতে গেলে দুই তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থন দরকার, সেটা তো তাদের কাছে নেই। তাই এটা স্পষ্ট, এই বিল নিয়ে তারা খুব বেশিদূর এগোতে পারবে না।”