রাফাহ শহরে বসবাসরত একজন ফিলিস্তিনি চিকিৎসক বলছিলেন যে, গাজার দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার শঙ্কায় তারা আতঙ্কিত। আগের রাতে বিমান হামলার পর তার কাছে মনে হচ্ছে, এই শহরে আশ্রয় নেয়ার পর এটি ছিল তার জন্য সবচেয়ে দুঃস্বপ্নের একটি রাত।
সোমবার বিবিসিকে দেয়া একাধিক বার্তায় চিকিৎসক আহমেদ আবুইবাইদ এই হামলাকে সর্বাত্মক ও অনবরত হামলা বলে বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
তিনি বলছিলেন, এখানকার মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, “আমরা এখন কোথায় যাবো?”
এর আগে গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, তিনি রাফাহ শহরে স্থল অভিযান বাড়ানোর জন্য সৈন্যদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
গাজার জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি প্রায় ২৩ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন মিশরের সীমান্তবর্তী এই শহরে। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সেখানে লোক সংখ্যা ছিল মাত্র দুই লাখ ৫০ হাজার।
ঘরহারা অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষ অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র বা বিভিন্ন তাঁবুতে বসবাস করছেন। এসব জায়গায় নিরাপদ পানি ও খাবারের অভাবও রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, রাফাহ শহরে হামলা চালালে তা হবে ভয়ঙ্কর, যাতে অনেক বেসামরিক লোক, নারী ও শিশু হতাহতের শঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরও বলেছেন, গাজায় যে অল্প মানবিক সাহায্য আসছিল, এখানে হামলা হলে সেটিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, বর্তমানে এসব সাহায্য বেশিরভাগই আসছে মিশর নিয়ন্ত্রিত রাফাহ সীমান্ত থেকে।
এদিকে সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ইসরায়েলের হামলার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সমালোচনা করে বলেন, “বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এ ধরনের হামলার পরিকল্পনা কখনোই সমীচীন হবে না”।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব লর্ড ক্যামেরন বলেছেন, “রাফাহ শহরে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার আগে ইসরায়েলকে থামতে হবে এবং গুরুত্ব দিয়েই ভাবতে হবে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল সোমবার ইসরায়েলের মিত্রদের অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করার আহবান জানিয়েছেন। কারণ, ইসরায়েলি হামলায় অনেক মানুষ মারা গেছে।
এর আগে রোববার এবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন, উত্তরাঞ্চলের বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্য একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে ইসরায়েল।
তিনি বলেন, “বিজয় এখন আমাদের হাতের নাগালে। যারা বলেন যে কোনও অবস্থাতেই রাফাহ প্রবেশ করা উচিত নয়, তারা মূলত বলতে চাইছে যুদ্ধে হেরে যাও এবং হামাসকে সেখানে রেখে এসো।”
গত বছরের সাতই অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের বন্দুকধারীরা ১২০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা এবং ২৫৩ জনকে জিম্মি করার পর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় বিমান হামলা ও স্থল অভিযান শুরু করে।
গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে ২৮ হাজার ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
রাফাহ শহরে বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে একজন হলেন আহমেদ আবুইবাইদ, যিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়, এছাড়াও এই হামলায় তার বাবা মেরুদণ্ডে আঘাত পান। পরে আহমেদ আবুইবাইদ নিকটবর্তী শহর খান ইউনিসের যে হাসপাতালটিতে কর্মরত ছিলেন, সেখানকার চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
এমন অবস্থায় তিনি রাফাহ ছেড়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু কোনো জায়গা তার জন্য নিরাপদ, সেটিও তার অজানা।
এই শহরে শিগগিরই একটি সামরিক স্থল অভিযানের শঙ্কায় এখানকার সবাই খুব ভীত, জানাচ্ছিলেন তিনি।
রবি থেকে সোমবারের মধ্যে রাতারাতি ইসরায়েলের হামলা ও দুই ইসরায়েলি জিম্মিকে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার সময় তারা সেখানে আশ্রয় নেয়া বেসামরিক লোকদেরও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে।
আবু মোহাম্মদ আত্তিয়া নামের একজন বাসিন্দা জানান, তিনি তার পরিবারের সঙ্গে তাঁবুতে ঘুমিয়ে ছিলেন। কিন্তু বোমা হামলার শব্দে তারা সবাই জেগে ওঠেন।
মি. আত্তিয়া বিবিসিকে বলেন, “হঠাৎ সব জায়গায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলছে, গুলি চালানো হচ্ছে, এবং বিমানগুলি সর্বত্র উড়ছে। তখন তাঁবুতে কিংবা তাঁবু থেকে বের হয়ে মানুষজন রাস্তায় চলে আসছিল।”
মি. আত্তিয়া এর আগে ছিলেন নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে। এর আগে যখন হামলা হয়েছে তখন আগে থেকে সতর্ক করা হতো ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষ থেকে। কিন্তু এবার রাফাহ হামলার আগে তেমন কোনও সতর্কতা দেয়া হয়নি ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষ থেকে, জানান মি. আত্তিয়া।
“আমরা আশা করেছিলাম যে, তারা নুসিরাতের মতোই সরে যাওয়ার জন্য একটি সতর্কতা দেবে। তারা যদি আগে থেকেই সতর্ক করতো আমাদের, তাহলে আমরা রাফাহ থেকে বেরিয়ে যেতে পারতাম। এখন আমাদের শিশুদের কথা চিন্তা করেই এখান থেকে সরে যেতে হবে”, ব্যাখ্যা করছিলেন মি. আত্তিয়া।
হামাস নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাফাহ শহরে ইসরায়েলি হামলা ও জিম্মি উদ্ধার অভিযানে অন্তত ৬৭ জন নিহত হয়েছে।
“এখানে আর কোনও নিরাপদ জায়গা নেই, এমনকি হাসপাতালগুলোও অনিরাপদ। এর চেয়ে মৃত্যু ভালো”, বলছিলেন মি. আত্তিয়া।
ক্রমাগত ইসরায়েলি বিমান হামলার হুমকি এবং স্থল অভিযানের কারণে রাফাহ শহরের মানুষের জন্য পানি, খাদ্য ও পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। এছাড়াও চিকিৎসা সেবা কমে যাওয়ায় জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
আহমেদ আবুইবাইদ বলছেন যে তিনি রাফাহ বাসিন্দাদের মধ্যে অনেক রোগ দেখেছেন। ওষুধের অভাবে রোগ বালাই আরও বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাফাহ শহরের এক চিকিৎসক বিবিসিকে বলেন, অনেক মানুষ সংকুচিত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করছে।
“আমি এখানে দুই কক্ষে ২০ জনের সঙ্গে থাকি এবং এমন লোককে চিনি যারা প্রতি তিনটি ঘরে ১০০ জনের মতো থাকেন। আমাদের ধোয়া-মোছা করার মতো পানি নেই, পোশাক নেই, স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনও সুযোগও এখানে নেই”, বলছিলেন তিনি।
“আমার বন্ধুদের সাথে আমার দেখা হয়, তাদের সাথে কথা বলেছি। অনেকেই কলেরা, ডায়রিয়া, স্কাবিস, হেপাটাইটিস আক্রান্ত হয়ে ভুগছে। আমাদের সামনে আরও খারাপ সময় আসছে।”
“হামলা বাড়ার সাথে সাথে সাহায্যও কম আসছে। ইসরায়েলি সৈন্যরা রাফাহ শহরের কাছাকাছি আসছে এবং এটি আমাদের জন্য খুব ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে”, বলছিলেন তিনি।
গাজা ও মিশরের মধ্যে একমাত্র ক্রসিং পয়েন্টের পাশেই অবস্থিত হলেও রাফাহ এলাকার মানুষের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট চিকিৎসা সেবাসহ অন্যান্য সাহায্য আসেনি এখানে।
এই শহরের একজন বিবিসিকে বলেন, মানুষ দিনের পর দিন ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। আর যখন সাহায্য এসেছিল, তখন পানির সরবরাহ বেশ অপর্যাপ্ত ছিল।
রাফাহ শহরের আরেক নারী জানান, “আমরা পানি খুঁজে পাচ্ছি না বা পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছি না। পানির অভাবে আমাদের গলা শুকিয়ে গেছে।”
ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডাব্লিউএ)-এর প্রধান সোমবার বলেছেন, “বেসামরিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় হামাস পরিচালিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিহত হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ নিজেদের নিরাপত্তার চিন্তায় সেবা দিতে ভয় পাচ্ছে।”
“গতকাল প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ ন্যূনতম সুরক্ষার সঙ্গেও কাজ করতে পারেনি। স্থানীয় পুলিশ না থাকায় সীমান্তে আমাদের ট্রাকসহ মালামাল লুট করা হয়েছে। ট্রাকগুলো ভাঙচুর করা হয়েছে। শত শত যুবক এর সাথে জড়িত ছিল।”
কোথায় যাবো জানা নেই
বাস্তুচ্যুত মানুষদের পরবর্তী ভবিষ্যত এখন একেবারেই অজানা। পানি ও খাবারের অভাবে দিন দিন এখানে আশ্রয় নেয়া মানুষদের উদ্বেগ বাড়ছে।
ইব্রাহিম ইসবাইতা নামের একজন বিবিসিকে বলেন, “আগে আমরা খাবার, পানি ও বিদ্যুতের ঘাটতির কথা ভাবছিলাম। কিন্তু এখন পরবর্তী পদক্ষেপ কী আর কোথায় যাবো তা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্থ।”
রাফাহ ছেড়ে যেতে হলে তিনি ও তার পরিবার কোথায় যাবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মি. ইসবাইতা বলেন, “আমার আসলে ধারণা নেই যে কোথায় যাবো।”
তিনি বলছিলেন, তার মায়ের ডায়ালাইসিস করা প্রয়োজন। যে সেবাটি তিনি রাফাহ শহরে পাচ্ছিলেন। কিন্তু এখান থেকে সরে যেতে হলে সেই চিকিৎসাটুকুও পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
“আমি আমার মায়ের জন্যই হাসপাতালের পাশে থাকি। এমন সমস্যা থেকে উত্তরণের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি,” যোগ করেন মি. ইসবাইতা।