অভিবাসী হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছে অনেকেই। তেমনি এসেছিল ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র জ্যামাইকা থেকেও অনেক পরিবার। এরকমই একটি পরিবারেই জন্মেছিলেন সদ্যপ্রয়াত সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল। ১৯৩৭ সালের ৫ এপ্রিল নিউইয়র্ক সিটির হারলেমে জন্ম হয় কলিন লুথার পাওয়েলের।
মারা যাওয়ার আগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন কলিন পাওয়েল। কিন্তু করোনায় তার মৃত্যু হয়নি। মৃত্যু হয়েছে করোনাপরবর্তী অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতায়। গত সোমবার (১৮ অক্টোবর) ৮৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
পাওয়েলের কর্মজীবন
ভূবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর পড়ালেখার সময় তিনি রিজার্ভ অফিসারদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দেন। এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল ভবিষ্যত সামরিক অফিসার বাছাই করা। পরে স্নাতক পাশ করে ১৯৫৮ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন।
১৯৬২ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামে যে কয়েক হাজার মার্কিন তরুণ অফিসার পাঠানো হয়েছিল কলিন পাওয়েল ছিলেন তাদের একজন। সেখানে তিনি এবং তার সহকর্মীরা মার্কিন সেনাদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। সেসময় ভিয়েতনামের ঘৃণ্য ‘মাই লাই গণহত্যা’র অভিযোগে অভিযুক্ত সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে। যদিও পাওয়েল তার সর্বাধিক বিক্রিত বই ‘মাই আমেরিকান জার্নি’তে লিখেছেন, ‘আমি সেসময় প্রশাসনের মূল পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতাম না।’ উল্লেখ্য, ভিয়েতনাম যুদ্ধের চার তারকা সম্মাননাপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ছিলেন তিনি।
১৯৮৭ সালে কলিন পাওয়েল আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হন। রিপাবলিকান নেতা জর্জ এইচ ডাব্লিউ বুশ ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। এটি আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ সামরিক পদ। তিনিই প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান যিনি ৫২ বছর বয়সে এই পদে আসীন হন। তার আগে এত কম বয়সে কেউ এ পদে বসেননি।
পরবর্তী সময়ে, ২০০১ সালে রিপাবলিকান নেতা জর্জ ডাব্লিউ বুশ (জুনিয়র বুশ) প্রেসিডেন্ট হলে প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান ব্যক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মি. পাওয়েল। এভাবে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসে অনেকগুলো ‘প্রথমের’ সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছেন তিনি।
পাওয়েল ডকট্রিন ও ইরাক হামলা
১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে ‘পাওয়েল মতবাদে’র প্রথম উন্মেষ ঘটে। এ যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তার রণকৌশল সামনে আসে। উপসাগরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের জয়ের পর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় পাওয়েলের। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে কলিন পাওয়েলকেই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হত।
পাওয়েল বিশ্বাস করতেন, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পথে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা ব্যর্থ হলে তবেই আমেরিকার সামরিক শক্তি ব্যবহার করা উচিত। সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন ১৯৯৩ সালে। এরপর আত্মজীবনী লেখা ও স্বেচ্ছাসেবায় সময় ব্যয় করতেন তিনি। এ সময়ই তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ৯/১১ হামলার পর কলিন পাওয়েল যুদ্ধে জর্জ ডাব্লিউ বুশকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেন। আজ পর্যন্ত মার্কিন প্রতিরক্ষানীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে বিবেচিত হয় তার এই সিদ্ধান্ত।
তিনি ইরাকে সরাসরি হামলার পরিবর্তে ধীরে ধীরে সাদ্দাম বিরোধী জোট গঠনের মাধ্যমে ইরাকের ওপর প্রভাব বিস্তারের পরামর্শ দেন বুশ প্রশাসনকে। এমনকি ২০০২ সালে এক ব্যক্তিগত নৈশভোজে পাওয়েল বুশকে বলেছিলেন, ‘আপনি শুধু এর অখন্ডতা ভেঙে ফেলেন, তাহলেই আপনি ইরাকের মালিক হয়ে যাবেন।’ এমনকি পাওয়েলই বুশকে ইরাক যুদ্ধে জাতিসংঘকে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
'পাওয়েলের চতুর খেলা'
দুর্ভাগ্যবশত পাওয়েল তার খ্যাতি ও সম্মানকে ভয়াবহ এক অপকর্মের কাজে লাগিয়েছিলেন। তার অবিসংবাদিত খ্যাতির কারণে বুশ প্রশাসন জাতিসংঘের মাধ্যমে ইরাকে অভিযান চালানোর পক্ষে কথা বলার জন্য বেছে নিয়েছিলেন তাকে। ২০০৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাওয়েল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দাঁড়িয়ে ওই যুদ্ধের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। পাওয়েল সিআইএর এজেন্ট জর্জ টেনেটের সঙ্গে মিলে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র থাকা এবং সাদ্দামের আল-কায়েদাসংশ্লিষ্টতার ‘কথিত প্রমাণ’ থাকার কথা জানান। যেহেতু সিআইএ বুশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হাতের পুতুল ছিল তাই বুশ প্রশাসন ইরাক জয়ের এজেন্ডাটি ম্যানুপুলেট করার জন্য সিআইএর সাহায্য নেয়।
পাওয়েলের মতো একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি প্রশাসনের এমন আগ্রাসী মনোভাবকে ব্যর্থ করার পরিবর্তে একে আরও শক্তিশালী ও প্রশ্নাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করে। বুশের প্রতি আনুগত্যের জন্য পাওয়েল জাতিসংঘ, অন্যান্য দেশ ও এমনকি মার্কিনিদেরও ইরাকবিরোধী মিথ্যা তথ্য দেন। ফলশ্রুতিতে আঠারো মাসের মধ্যে সাদ্দামের পতন ঘটে।
পাওয়েল পরে স্বীকার করেন যে, ইরাকে ‘ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রসম্ভার’ থাকার গোয়েন্দা তথ্য ভুল ছিল এবং তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। ইরাক যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, হত্যাযজ্ঞ তকে খলনায়কে পরিণত করে।
দলবদল
মধ্যপন্থী রিপাবলিকান কলিন পাওয়েলের সঙ্গে তার দলের বিচ্ছেদ ঘটে ২০০৮ সালে। তিনি সে বছল ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ওবামাকে এগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পাওয়েলের এই সমর্থনকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। এরপরেও বেশ কয়েকজন শীর্ষ মার্কিন রাজনৈতিক নেতার সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
ইরাক যুদ্ধ: জীবনে একটি কালো দাগ
ইরাক যুদ্ধে সমর্থন সংগ্রহে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেজন্য তিনি সারাবিশ্বে তীব্র্র সমালোচনার শিকার হন। সেসময় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া নিজের বক্তব্যকে জীবনের একটি ‘কালো দাগ’ বা ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়ান হার্ড বলেন, ‘লক্ষ লক্ষ ইরাকি এবং হাজার হাজার মার্কিন সেনার মৃত্যুর জন্য কোনো শাস্তি তিনি পাননি। জাতিসংঘে পাওয়েলের সেই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে ইরাকের সঙ্গে মার্কিন জোটের যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো তা ধীরে ধীরে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে ফেলেছে। মার্কিন জোটও এতে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।’
অধ্যাপক ইয়ান আরো বলেন, এমনকি পাওয়েল মাঝে মাঝে ইরাক যুদ্ধের দায় অস্বীকার করে বলতেন, ‘এর জন্য আরও অনেকেই দায়ী।’
যদিও ২০০৫ সালে এবিসি নিউজ চ্যানেলকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পাওয়েল বলেছিলেন, ‘এটা তখনও ছিল কষ্টকর, এটা এখনও আমাকে কষ্ট দেয়।’
ইরাকিদের চোখে কলিন পাওয়েল
অনেক ইরাকিদের জন্য, কলিন পাওয়েল হলেন সেই মার্কিন মৃত্যুদূত যিনি ২০০৩ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গিয়ে তাদের দেশের বিরুদ্ধে একটি বিধ্বংসী যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিয়েছিলেন।
৮৪ বছর বয়সে পাওয়েলের মৃত্যু হলেও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের জীবনে যে কালো ছায়া নেমে আসে ২০০৩ সালে, তা এখনও শেষ হয়নি। জাতিসংঘে তার দেওয়া সাক্ষ্য এক মুহুর্তে লাখ লাখ ইরাকির ভাগ্য বদলে দিয়েছিলো।
মারিয়াম (৫১) নামের উত্তর ইরাকের এক লেখিকা পাওয়েলের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সে মিথ্যার পর মিথ্যা বলে গেছে আমাদের দেশের ব্যাপারে। তার বলা মিথ্যার কারণে আমরা এমন এক যুদ্ধের জালে জড়িয়েছি, যা থেকে মধ্যপ্রাচ্যবাসীর মুক্তি নেই।’
জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার এক পর্যায়ে পাওয়েল একটি কাঁচের শিশিতে করে আনা নকল অ্যানথ্রাক্স ভাইরাস দেখিয়ে বলেছিলেন, ইরাকের কাছে থাকা মারণাস্ত্রের ভয়াবহতার কাছে অ্যানথ্যাক্সের ভয়াবহতা কিছুই না। জাতিসংঘে দেওয়া তার ভুয়া ভাষণ কর্মজীবনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
২০০৮ সালে বাগদাদে এক সংবাদ সম্মেলনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের দিকে জুতা ছুঁড়ে মারা সাংবাদিক মুনতাজার আল জাইদি পাওয়েলের মৃত্যুর পর টুইটে লিখেছেন, ‘ইরাকের সঙ্গে করা অপরাধের বিচার হওয়ার আগেই কলিন পাওয়েলের মৃত্যুতে আমি দুঃখিত... কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আল্লাহর আদালত তার বিচার করার জন্য তৈরি আছে।’
সূত্র: বিবিসি, এমএসএনবিসি, টিআরটি ওয়ার্ল্ড, এনপিআর, আলজাজিরা।