ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪, ০৫:৪৩ পিএম
চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে (আলিফ) হত্যার ঘটনায় মামলার তদন্তপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না বলে মনে করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। সংগঠনটি বলছে, এই হত্যা মামলা ঘিরে গ্রেপ্তার–বাণিজ্যের স্বার্থ আর সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে ফায়দা লোটার গোষ্ঠীস্বার্থ সমান্তরালভাবে সচেষ্ট।
‘চট্টগ্রামে আইনজীবী আলিফ হত্যাকাণ্ড–পরবর্তী পরিস্থিতি সরেজমিন পরিদর্শন: পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাব’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। খবর প্রথম আলো।
রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে তারা এ সংবাদ সম্মেলন করে।
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গত ২৫ নভেম্বর ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়। তার পরদিন তাঁকে চট্টগ্রাম আদালতে উপস্থিত করা হলে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার শিকার হন।
চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করতে গত ২৩ ডিসেম্বর গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রামে যায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি আজ তাদের পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাব তুলে ধরল।
সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি জানায়, আইনজীবী সাইফুল হত্যাকাণ্ড ও সংঘাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত ছয়টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৩৯০ জনকে নাম উল্লেখ করে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং ২ হাজার ৪০০ জনের অধিক ব্যক্তিকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি থাকার কারণে গ্রেপ্তার–বাণিজ্য চলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হরিজন কলোনির ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। যারা কাজ করেন, তাঁরা বাদে বেশির ভাগ পুরুষই বাড়ির বাইরে পালিয়ে আছেন বলেও উল্লেখ করেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি।
সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ বলেন, অজ্ঞাতনামা আসামির মধ্যে যে কেউ পরতে পারে, সুতরাং একটা ব্যাপক হয়রানি শুরু হয়েছে। পুলিশের যে গ্রেপ্তার–বাণিজ্য এবং যারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, তারা যেকোনো ব্যক্তিকে এটার জন্য হয়রানি করতে পারে, হুমকি দিতে পারে, টাকা আদায় করতে পারে। এগুলো হাসিনা আমলে চলেছে। বিষয়টি পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, এর একটা সাম্প্রদায়িক দিক আছে, যেটা নিয়েও তাঁরা খুবই উদ্বিগ্ন। যারা ধর্মের নামে বৈষম্য তৈরির রাজনীতি করে, তাদের একটা তৎপরতা তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন। তারা এখন উসকানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে।
গ্রেপ্তার–বাণিজ্যের স্বার্থ ও সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে তার থেকে ফায়দা লোটার কিছু গোষ্ঠীস্বার্থ—এ দুই স্বার্থ একসঙ্গে হয়ে চট্টগ্রামে একটা অবস্থা তৈরি করেছে উল্লেখ করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, সামনে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। এই অনিশ্চয়তা থেকে আরও সমস্যা তৈরি হতে পারে এবং পুরো বাংলাদেশ এটার জন্য কলঙ্কিত হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বলেছে, আইনজীবী সাইফুল হত্যাকাণ্ডের দিন হরিজন কলোনির দুটি মন্দির ও আটটি বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। ঘটনার দুই দিন পর ২৯ নভেম্বর পবিত্র জুমার নামাজের পর একদল দুষ্কৃতকারী হরিজন কলোনিতে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। এ সংবাদ কোনো মিডিয়ায় আসেনি। হরিজনদের মন্দির ও বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পার করে এসেও শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এবং ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির টোপ হিসেবে ব্যবহার করার যে প্রবণতা, সে কারণে একটা সম্প্রদায়ের মানুষকে এভাবে প্রান্তিকতার শিকার হতে হচ্ছে। সে বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে তেমন কোনো রেসপন্স (সাড়া) পাওয়া যাচ্ছে না। তখন নাগরিক হিসেবে শঙ্কিত হতে হয় এবং ভাবতে হয়, জুলাই–আকাঙ্ক্ষার নাম দিয়ে যা চলছে, তার মধ্যে জনগণের জায়গা কতটুকু।
আজকের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘মামলা দায়ের ও তদন্তপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। মামলাগুলোয় গণহারে আসামি করা ও তদন্ত পরিচালনার পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করে আমাদের মনে হয়নি যে এই হত্যার সঠিক বিচারের প্রশ্নে এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিভাগ আন্তরিক। আমরা চট্টগ্রামে পরিদর্শন শেষে ঢাকায় ফেরার পরে স্থানীয় থানার একজন এসআই সেবকপল্লিতে গিয়ে হরিজনদের হুমকি দিয়ে এসেছেন এবং বলেছেন, তারা (হরিজনদের) যদি প্রকৃত অপরাধীদের ধরিয়ে দেয়, তবে যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবেন। হিন্দুধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষও গ্রেপ্তার–আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।’
আইনজীবী সাইফুলকে কে বা কারা হত্যা করেছে, সেটা বের করা অসম্ভব বলে মনে হয়নি উল্লেখ করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বলেছে, আদালতের সামনের রাস্তা থেকে ঘটনাস্থল পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি সিসি ক্যামেরা আছে। এমনকি ঘটনাস্থলের পাশেই ৩ থেকে ৪টি সিসি ক্যামেরা আছে। সেই ক্যামেরাগুলোর অবস্থান দেখে মনে হয়েছে, ফুটেজ দেখে ঘাতকদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। কিন্তু এই ফুটেজগুলোর ব্যাপারে কোনো আলোচনাই শোনা যাচ্ছে না।
সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে মামলা দেওয়া, গ্রেপ্তার করার বিষয়গুলো যেকোনো মূল্যে এড়িয়ে যেতে হবে বলেও মনে করেন আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন। আজকের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চট্টগ্রাম বারের অনেক আইনজীবী জুলাই অভ্যুত্থানে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তাঁদের অনেকের নামে এখানে মামলা হয়েছে। এটি অত্যন্ত নিন্দনীয়। একজন আইনজীবীর অধিকার রয়েছে তাঁর আইনগত পেশা চালিয়ে যাওয়ার। সেখানে আইনজীবীদের তাঁদের পেশা চালিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
৫টি প্রস্তাব
সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরে। সেগুলো হলো, আইনজীবী সাইফুল হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, আদালত প্রাঙ্গণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ভাঙচুরের ঘটনার সঠিক তদন্ত, এই ঘটনায় উসকানিদাতাদের খুঁজে বের করা। একই সঙ্গে ঘটনার সময়ে সেবকপল্লিতে ও পাশের আরেকটি হিন্দুপল্লিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা করে বিচার নিশ্চিত করারও দাবি করা হয়।
যারা এ পরিস্থিতিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে নিয়ে যেতে চাইছিল, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয় প্রস্তাবে।
প্রস্তাবে বলা হয়, অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বান্ডেল রোডের সেবকপল্লির হরিজনদের হয়রানি ও সেখানে যে ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। গণগ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তার–বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজগুলো পরীক্ষা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ব্যতীত কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
এ ছাড়া চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ সব অভিযুক্ত ও আটক ব্যক্তির বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতেরও দাবি করা হয়।