জুন ২৪, ২০২৩, ০৯:৫৫ পিএম
দুদকের একজন পিয়ন তার সাথে পুলিশের চাকুরি থেকে বহিষ্কার হওয়া এক যুবকসহ বায়তুল মোকারমের একজন ব্যবসায়ী মিলে সঘোষিত দুদক টিম তৈরি করে দুদকের নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের দুদকের তলবের চিঠি দিত ও কোটি টাকা চাঁদা আদায় করত। এরকম প্রতারক চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি লালবাগ বিভাগ।
এ বিষয়ে ৪ জুন শনিবার ডিবি প্রধান হারুন উর রশিদ এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত বলেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলো - ১. গৌতম ভট্টাচার্য (৪২), ২. হাবিবুর রহমান (৪২), ৩. পরিতোষ মন্ডল (৬৩), ৪. মোঃ এসকেন আলী খান (৫৭)।
ডিবি প্রধান বলেন, আশিকুজ্জামান একজন সি এন্ড এফ ব্যবসায়ী। বায়তুল মোকাররম মসজিদের কার্পেটের দোকানে ইমপোর্ট করা কার্পেট ও জায়নামাজ সরবরাহ করে থাকেন। গত ১৯ জুন তার স্ত্রী সন্তান প্রসব করা সংক্রান্তে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ২০ জুন সকালে আশিকুজ্জামানের বাসায় দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের খামে ১টি নোটিশ নিয়ে একজন অফিসার হাজির হন।
কার্পেটের ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণের চোরাচালান এবং মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ তুলেন আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে। স্ত্রীর হসপিটালে অবস্থান এবং দুদকের এই ভয়ানক অভিযোগ শুনে ঘাবড়ে যান আশিকুজ্জামান। তখন দুদকের সেই অফিসার আশিকুজ্জামানকে একটু সহানুভূতি দেখানোর ভান করে তাকে তখনই মোবাইল বন্ধ করে দিয়ে আত্মগোপনে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়।
ভয় দেখান ডিবি, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক এবং এনএসআই নাকি দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয় তাকে ধন্য হয়ে খুঁজছে। দুদকে তাঁর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে।
নোটিশ বহনকারী ব্যক্তিটি হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে আশিকুজ্জামানকে কথা বলিয়ে দেয়। হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের ঐ কর্মকর্তা মোবাইলে কথা বলা সমীচীন নয় মর্মে ডিটেইল্স জানার জন্য তাকে দুদক অফিসে যেতে বলেন।
দুদকের নোটিশে বিভিন্ন অভিযোগের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়, শূন্য থেকে সে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। তাকে দুদকের জিম্মায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সকল প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমতাবস্থায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। কারণ দর্শানোসহ ব্যক্তিগত শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করা হয় ১০ জুলাই।
আশিকুজ্জামানকে হোয়াটসঅ্যাপে দফায় দফায় ফোন দেয়া হয়। ভয় দেখানো হয় সম্পত্তি ক্রোক করা, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করা, প্রিন্টেড ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে বেজ্জতি করাসহ সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনএসআই, ডিবি পুলিশ এবং দুদকের দ্বারা গ্রেফতার করিয়ে কঠোর শাস্তির ভয় দেখানো হয়।
এক পর্যায়ে আশিকুজ্জামানকে মতিঝিলের হীরাঝিল হোটেলের দ্বিতীয় তলায় এসে সমঝোতার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। সমঝোতা অনুসারে প্রথমে দুই কোটি টাকা দিতে বলা হলেও পরবর্তীতে দিতে বলা হয় এক কোটি টাকা। বিনিময়ে সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা দেয়া হয়। ১ কোটি টাকার ভিতর ২৩ জুন শুক্রবার ২০ লক্ষ টাকা প্রদান করতে বলা হয়। বাকি টাকা আগামী রবিবার পরিশোধের সমঝোতা হয়।
ভিকটিম বিষয়টি গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগকে অবহিত করলে তারা দুদকের সাথে যোগাযোগ করে। দুদকের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলামসহ হোটেল হীরাঝিল হোটেলের আশেপাশে অবস্থান নেয়।
সমঝোতা অনুসারে ভিকটিম আশিকুজ্জামান চারটি মিষ্টির প্যাকেটে তার স্বাক্ষরিত দেড় লক্ষ টাকা ভরে হোটেল হীরাঝিলে যান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে সংরক্ষিত টাকা নেয়ার সময় তাদের গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
গ্রেফতারকৃতদের মিষ্টির ৪টি প্যাকেট, নগদ দেড় লক্ষ টাকা, ৪টি মোবাইল ফোন, দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের ১টি খাম ও দুদকের একটি নোটিস উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে গৌতম ভট্টাচার্য দুদকের ডিজি মানি লন্ডারিং এর পিএ হিসেবে কর্মরত, বাড়ি মৌলভীবাজার। এসকেন আলী খান চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য, বাড়ি গোপালগঞ্জ। অপর দুইজন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা এবং পেশাগত ভাবে দালাল ও প্রতারক।
গৌতম ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে দুদকের বিভিন্ন মহাপরিচালকদের পিএ হিসেবে কাজ করে আসছে। সে কখনো দুদকের ডিজি (তদন্ত), ডিজি (এডমিন), ডিজি (প্রসিকিউশন), ডিজি (মানি লন্ডারিং) এর অফিসের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (পিএ) হিসেবে কাজ করে আসছে। গৌতম ভট্টাচার্য কর্ম সূত্রেই জানে দুর্নীতি সংক্রান্তে কিভাবে মানুষকে নোটিশ পাঠাতে হয়, কিভাবে তাদের কাছ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক ব্যাখ্যা নেয়া হয় এবং কিভাবে অভিযোগ গঠন করা হয়। এই অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সে তার দুষ্কর্মের সহযোগীদেরকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং চাকুরীজীবীকে টার্গেট করে তাদের ব্যক্তিগত নানা তথ্য সংগ্রহ করে দুদকের চিঠির খাম ও প্যাড/ ফরমেট ব্যবহার করে অভিযোগের নোটিশ পাঠাতো। পরবর্তীতে কখনো মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে, কখনো শিল্পকলা একাডেমীর ভিতরে বসে, কখনো আশেপাশের বিভিন্ন হোটেলে টার্গেটের টাকায় খেতে খেতে তাদেরকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি দান/ সমঝোতার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
এদের সাথে দুদক কার্যালয়ের দায়িত্বশীল আরও কেউ জড়িত আছে কি না - খতিয়ে দেখার জন্য আসামিদের জিজ্ঞাসা করা হবে।