বার্গার, পিজ্জা, চিজ, ঘি বা তেলে ভাজা অনেক খাবারই আমাদের নিত্যদিনের তালিকায় থাকে। অথচ এ জাতীয় ফাস্টফুড ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশের প্রতি ৫ জন তরুণের ১ জন। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি যে রোগে মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় তা হলো হৃদরোগ। হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর হার কোভিডের চেয়ে ৩/৪ গুন বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ট্রান্স-ফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই অবিলম্বে ট্রান্স-ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করা না গেলে ট্রান্স-ফাটঘটিত হৃদরোগের ঝুঁকি আশংকাজনক হারে বাড়তেই থাকবে।
গত ১৮ মাসে ভয়াবহ কোভিডে সারা বিশ্বে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের প্রাণ হারিয়েছে। একইসময়ে হৃদরোগ ও রক্তনালীর রোগে মারা গিয়েছে ২ কোটি ৭৯ লক্ষ মানুষ। কার্ডিওভাসকুলার রোগের এই নীরব আঘাত প্রায়ই আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এখন পর্যন্ত হৃদরোগ ও রক্তনালীর জটিলতায় সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি (সকল মৃত্যুর ৩১%) মানুষ মারা যায়। প্রতি বছর ৫২ কোটি মানুষ এই রোগে ভুগছে। গত ১ বছরে এধরনের রোগে বাংলাদেশে ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছে।
ঘাতকব্যাধি হৃদরোগ:প্রতিরোধের উপায় কী?
সবার আগে সচেতন হতে হবে। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে, আপনি এই রোগ প্রতিরোধ করতে চান কিনা। দৃঢ় সংকল্প করুন। আগামীকাল থেকে নয়। আজকে থেকেও নয়। এখন থেকেই আপনি প্রস্তুত? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে আপনার কাজ ৫০% হয়ে গেল!
বাকী ৩০% অর্জনে ব্যায়াম করুন, ওজন কমান
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলুন। গুগল সার্চ করে জেনে নিন আপনার উচ্চতায় আদর্শ ওজন কত হওয়া উচিত। উচ্চতা আর ওজনের অনুপাত করে Body Mass Index বা BMI বের করে নিন। (দেখুন Google BMI Calculator) আমাদের আদর্শ BMI হল ১৯ থেকে ২৪.৯ ।
ওজন কমানোর দুটি উপায় আছে: ক) প্রথম ও গরুত্বপূর্ণ উপায় হল শর্করা জাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রণ করা। ভাত, রুটি, আলু, চিনি, মিষ্টি, মিষ্টান্ন, চাল গম দিয়ে তৈরী যাবতীয় খাবার কমিয়ে দিতে হবে। পরিমাণ মত চর্বি, পর্যাপ্ত মাছ, সাদা মাংস (মুরগী), কুসুমসহ একটি ডিম, ইচ্ছে মত শাকসব্জি, সালাদ, পরিমিত তাজা ফল এবং কমপক্ষে ২ লিটার পানি খেতে পারবেন। যদি ক্যালরি মেপে খেতে চান তাহলে প্রতিদিন ১০০০ কিলোক্যালরির বেশি শর্করা গ্রহণ করবেন না।
খ) ওজন কমানোর দ্বিতীয় কিন্ত কার্যকর পদ্ধতি হল নিয়মিত ব্যায়াম করা। খোলা জায়গায় সপ্তাহে কমপক্ষে ৫ দিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিট জোরে জোরে হাঁটুন যাতে শরীরে ঘাম ঝরে এবং হার্টিবিট ১২০ পর্যন্ত ওঠে। শুধু হাঁটাচলা বা ব্যায়ামে ওজন তেমন একটা না কমলেও তা হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীকে সচল রাখে, ব্লকমুক্ত রাখে, প্রেসার কমায়, ডায়াবেটিস কমায়, কোলেস্টেরল কমায়, শরীরের শেইপ ঠিক রাখে, কর্মক্ষমতা বাড়ায়, ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বাড়ায় এবং মনকে সতেজ রাখে।
ব্যায়াম বা হাঁটাচলার মধ্যে অন্তত ১৫/২০ মিনিট রোদে হাঁটুন। বাইরে যেতে না পারলে ছাদে বা বারান্দায় বসে শরীরে রোদ লাগান। এতে ভিটামিন ডি তৈরীতে সহায়ক হয়।
২। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করুন
উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার এক নীরব ঘাতক। নীরব ঘাতক এজন্য যে, ৯০% ক্ষেত্রেই কোন উপসর্গ দেখা দেয় না। উচ্চ রক্তচাপ ক্রমাগত বহাল থাকলে তা হার্ট, কিডনী, ব্রেন, চোখের রেটিনা এবং পায়ের রক্তনালী সহ সারা শরীরের ক্ষতি করে। যখন উপসর্গ দেখা দিবে তখন দেখা যাবে ঐসমস্ত অঙ্গ ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাই উপসর্গের অপেক্ষায় না থেকে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করুন। নিজে নিজে ওষুধ খাবেন না বা বন্ধও করবেন না। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করুন। কাচাঁ লবণ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৩। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করুন
বয়স ৩০ হলেই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করুন। বছরে অন্তত একবার। তবে একটা স্যাম্পলে অনেক সময় প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। তাই কমপক্ষে দুটো স্যাম্পল নিয়ে টেস্ট করুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই টেস্টই যথেষ্ট । তবে যখন সন্দেহজনক বর্ডারলাইন রেজাল্ট আসবে তখন OGTT পরীক্ষা করাতে হবে।
ডায়াবেটিস হয়ে থাকলে প্রথম ধাপ নিয়মিত ডায়েট এবং ব্যায়াম। এই পদ্ধতিতে সুগার নিয়ন্ত্রণ না হলে ওষুধ প্রয়োজন হয়।
৪। ছাড়ুন ধূমপান, তামাকজাত দ্রব্য ও এলকোহল
সকল প্রকার তামাক, জর্দা, গুল, বিড়ি, সিগারেট অবিলম্বে বর্জন করুন। তামাক শুধু হৃদরোগ, স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়ায় না নানা ধরনের ক্যানসার, ব্রংকাইটিস ইত্যাদির কারণও সে। মনকে শক্ত করুন। নেশাদ্রব্য ছেড়ে দিন।
এলকোহল প্রেসার বাড়ায়। রক্তের চর্বি ট্রাইগ্লিসারাইড বৃদ্ধি করে হার্ট এটাক, লিভার সিরোসিস, প্যানক্রিয়াটাইটিস সহ নানা অপকর্ম ঘটায়। শরীর ভাঙ্গে, ভাঙ্গে সংসারও।
৫। দুটো ওষুধ কখনো বন্ধ করবেন না
যাঁদের একবার হৃদরোগ, রক্তনালীতে ব্লক ধরা পড়েছে, হার্ট এটাক হয়েছে, ব্রেন স্ট্রোক করেছে তারা দুটো ওষুধ সারাজীবন খেয়ে যাবেন। একটি হল কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ (statin), আর দ্বিতীয়টি হল রক্ত পাতলা করার ওষুধ। শুধুমাত্র হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সাময়িককালের জন্য স্থগিত রাখা যেতে পারে।
যাদের ডায়বেটিকস ধরা পড়েছে তারা কখনোই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ওষুধ বন্ধ করবেন না। হাই কোলেস্টেরল নিজেই ডায়াবেটিসের মত একটি দীর্ঘস্থায়ী,সম্ভবত আজীবন সঙ্গী একটি সমস্যা। রক্তনালীতে ব্লক তৈরীর মূল উপাদান হল চর্বি। তাই সুগার কন্ট্রোল করার মত চর্বিও সারাজীবন কন্ট্রোল করতে হবে।
৬। বাকী ২০%ভাগের চিকিৎসা: প্রতিকার
প্রতিরোধের পালা শেষ হলে বা আগেই আক্রান্ত হলে যথাযথ চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সেখানে ইসিজি, ইটিটি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, এনজিওগ্রাম, রিং পরানো বা এনজিওপ্লাস্টি, ওপেনহার্ট বা বাইপাস সার্জারীসহ নানা ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যাপার চলে আসবে।