খুকুমণি বেঁচে থাকবেন পত্রিকাপ্রিয় মানুষদের হৃদয়ে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ১৪, ২০২৩, ০৯:১৭ এএম

খুকুমণি বেঁচে থাকবেন পত্রিকাপ্রিয় মানুষদের হৃদয়ে

খুকুমণি নামের রাজশাহী শহরের একজন নারী হকার মারা গেছেন। অনেকের পোস্টে এমন খবর পড়লাম। এরপর বিভিন্ন সাইট সার্চ করে যা জানলাম, তিনি সংগ্রামী এক নারী ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর এই দেশের কঠিন সামাজিক জীবনে তিনি প্রতিনিয়ত বাধা ডিঙিয়েছেন। সাংবাদিকতাকে তিনি মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন বোধ হয়। আর সেই ভালোবাসার টানই শেষ পর্যন্ত তাঁকে পত্রিকা বিক্রির পেশায় নিয়ে গেছে। তাঁর এই সংগ্রামী জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ জয়ীতা পুরস্কার লাভ করেছিলেন। আমি নিজে সাংবাদিকতা পেশায় আছি। এ কারণেই কিনা জানি না, হাজারো সংবাদের ভীড়ে তাঁর এই প্রয়াণের খবর আমার হৃদয়ে হাহাকার জাগিয়েছে।

পত্রিকান্তরে যা জানলাম, বৃহস্পতিবার ১৩ই এপ্রিল দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে রাজশাহী নগরীর মহিষবাথান এলাকার ‘মিশনারিস অব চ্যারিটি আশাদান মাদার তেরেসা আশ্রমে’ চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।

তিনি প্রায় তেত্রিশ বছর ধরে এই পত্রিকা বিক্রির পেশায় নিমগ্ন ছিলেন। তিনি হয়তো শুধু বিক্রিই করেননি, পড়েছেনও তাঁর প্রিয় পত্রিকাগুলো। যে কারণে শিরদাঁড়া কখনো বাঁকা করেননি তিনি। তিনি এজেন্টদের কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়ে খবরের কাগজ কিনে নিতেন, কখনও বাকি রাখতেন না। কারো কাছ থেকে সহায়তাও নিতেন না, এই নেওয়াটা অসম্মান বলে মনে করতেন তিনি। বরং তিনি অন্যদের প্রয়োজনে তাদের দান-সহযোগিতা করতেন। বিশেষ করে মেয়েদের নানা প্রয়োজনে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়াতেন। অথচ তিনি নিজেই চলতেন কষ্ট করে।

রাজশাহী নগরের শিরোইল এলাকায় তাঁর বাড়ি। অসুস্থ হওয়ার আগে ওখানেই বসবাস করতেন তিনি। ১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন খুকুমণি। ফলে এলাকার লোকজন তখন পাগলী বলে ডাকতো তাঁকে। কিন্তু তিনি গায়ে মাখতেন না মানুষের ওসব মন্তব্য।

কারো দয়ার পাত্রী না হয়ে বেছে নিয়েছিলেন সংবাদপত্র বিক্রির কঠিন এক পেশা। সারাদিন শহরের বিভিন্ন রাস্তায়, অলিতে-গলিতে ঘুরে ঘুরে সংবাদপত্র বিক্রি করতেন। মাইলের পর মাইল হাঁটতেন তিনি। তাঁর কাঁধে ঝুলে থাকতো সংবাদপত্রভরা একটি কাপড়ের ব্যাগ। অনেকটা কবি কবি চেহারার মানুষটি অনেকের ভালোবাসা কুড়ালেও কিছু মানুষ করতো উপহাস। মানুষের এসব উপহাস, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা পেলেও তিনি দমে যাননি কখনো।

পত্রিকা পড়ে পড়ে তিনি হয়তো নিজেকে ধৈর্যের অবতার হিসেবে তৈরি করে নিয়েছিলেন। তাঁর ভালো আচরণ, সুন্দর করে কথা বলা, নিয়মানুবর্তীতার কারণে গ্রাহকেরা তাঁর কাছ থেকে কাগজ কিনতে পছন্দ করতেন। যৌবনে সুন্দরী হওয়ার কারণে তাঁকে বারবার রাস্তায় হয়রানি ও লাঞ্ছনা করেছে যুবকের দল। এতেও তিনি থেমে যাননি।

খবরের কাগজ বিক্রি করতে গিয়ে মানুষের নানা বিরূপ আচরণের শিকার হওয়া তাঁর নিত্য ঘটনা ছিল। তাঁর আত্মমর্যাদার জন্য লড়াইয়ের কথা না জেনে অনেকে তাঁর সাথে খারাপ ব্যবহার করতো। তিনি তখন বলতেন: ‘আমি খবরের কাগজ বিক্রি করে নিজের জীবন চালাই, এটা কি অসম্মানের? এটা কীভাবে অন্য কারো মানহানি করে? কোনো কাজই তো ছোট নয়।’

বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতায় এরকম তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তিনি বলেছেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা বর্ননায় অভিযোগ ছিল না কোনো। তিনি শুধু বাস্তবতা তুলে ধরতেন।

২০২০ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুকুমণির জীবন-সংগ্রামের একটি ভিডিও প্রকাশ পেলে সেটি আলোড়ন ফেলে নেটিজেনদের মাঝে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরেও আসে। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জেলা প্রশাসন খুকুমণির পাশে দাঁড়ায়। একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে ২০২০ সালে খুকুমণি জয়িতা পুরস্কার পান।

খুকি বা খুকুমণি তাঁর ডাক নাম। পুরো নাম জোহরা দিল আফরোজ খুকি। বাংলাদেশে বোধ হয় বাবা-মায়েদের কাছে মেয়ে সন্তানদের সবচেয়ে আদরের নাম এই খুকু বা খুকি। খুকুমণির বাবা-মাও বোধ হয় সেই আদর আর ভালোবাসার তীব্রতার জায়গা থেকেই তাঁর ওই নাম রেখেছিলেন। কিন্তু এ সমাজে প্রতিষ্ঠা বলতে যা বুঝায়, সেই প্রতিষ্ঠা তাঁর পাওয়া হয়নি সংগ্রাম মুখর জীবনে। তাতে কি, তিনি যে সৎ আর সাহসিকতা দিয়ে বাঁচতে শিখিয়ে গেছেন অগণন মানুষকে, সেই অর্জনও কোনো অংশে কম নয়। তাঁর দেহের প্রয়াণ ঘটলেও তিনি বেঁচে থাকবেন ওই অঞ্চলের পত্রিকাপ্রিয় মানুষদের হৃদয়ে বহু বহুকাল।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ।

Link copied!