পুতিন কি পারবেন শেষ পর্যন্ত টিকতে?

মিজানুর রহমান খান

মার্চ ২, ২০২২, ১২:৩৩ এএম

পুতিন কি পারবেন শেষ পর্যন্ত টিকতে?

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ঘরে-বাইরে নজিরবিহীন এক চাপের মুখে পড়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রুশ আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিভিন্ন দেশে তার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। খোদ রাশিয়ার বিভিন্ন শহরেও চলছে বিক্ষোভ সমাবেশ। এ অবস্থায় পুতিন কি তার ক্রেমলিন প্রাসাদ হারাতে চলেছেন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মুখে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নানা নিষেধাজ্ঞায় বড় ধরণের সংকটে পড়েছে রুশ অর্থনীতি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার রুশ অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে অর্থনীতি সামাল দেওয়ার নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন পুতিন। সোমবার স্থানীয় মুদ্রা রুবলের মান ৩০ শতাংশ হ্রাস পায়।

ইউক্রেন যুদ্ধে মিত্র হিসেবে একমাত্র বেলারুশের প্রেসিডেন্ট অ্যালেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো ছাড়া পুতিনের পাশে আর কেউ নেই! একদিকে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার বোঝা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেকটা একঘরে হয়ে যাওয়ার পথে রাশিয়া। সব মিলিয়ে নানাবিধ চাপের মুখে পড়েছেন পুতিন। এ অবস্থা তাকে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত করে কিনা, এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন, সিবিএস, কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরাসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ইউক্রেনে হামলার প্রতিবাদে খোদ রাশিয়াতেই বেশ প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। রাশিয়ার ঐতিহাসিক শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ, লেলিনগ্রাদ, ইয়েকাতেরিনবুর্গ, ভলগোগ্রাদসহ বেশ কয়েকটি শহরে পুতিনবিরোধী আন্দোলন চলছে। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান দিয়েও আন্দোলন দমানো যাচ্ছে না। সাধারণ জনগণের পাশপাশি তারকা, এমনকি প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। অথচ কিছুদিন আগেও স্ট্রংম্যান ইমেজের পুতিনের বিরুদ্ধে এমন আচরণ ছিলো কল্পনাতীত।

গত দুই দশকে রাশিয়ার অবিসংবাদিত নেতা বনে গেছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র প্রধান পুতিন। সোভিয়েত পরবর্তী নাজুক হয়ে পড়া মস্কোকে অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত করার কৃতিত্বও দেওয়া হয় তাকে। তবে ইউক্রেনে হামলার পর দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রুশ অর্থনীতি। প্রতিদিনই বাড়ছে নিষেধাজ্ঞা আর অবরোধের তালিকা। কূটনৈতিকভাবেও পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে দেশটি। তাই ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে ভুল করলেন কিনা সেটিই এখন প্রশ্ন।

রাশিয়ান কমনওয়েলথ নামে পরিচিত সিআইএসের ইউক্রেন বিষয়ক প্রধান ইভান স্করিকভ এক সাক্ষাৎকারে সিএনএনকে বলেন, ইউক্রেনের এই সংঘাতময় পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো গত ৮ বছর ধরে ইউক্রেনকে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ইউক্রেনকে ব্যবহার করেই লড়াইটা মূলত চলছে রাশিয়া এবং পশ্চিমা শক্তির মধ্যে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বিপদে পড়বেন পুতিন। অর্থনীতি হচ্ছে সব বিষয়ের অন্যতম প্রধান অস্ত্র। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চললে আর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের মাঝে অসন্তোষ বাড়বে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার সাবেক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই ফেদোরভ বলেন, পুতিন যে লক্ষ্য নিয়ে অভিযান শুরু করেছিলেন, তা এখনো অর্জিত হয়নি। তবে রাশিয়া বেশি সময়ও নেবে না।

ফেদোরভ আরও বলেন, “পুতিনের প্রাথমিক নির্দেশ ছিল জয় দিয়ে ২ মার্চের মধ্যে অভিযান শেষ করা। তবে ইউক্রেনের প্রতিরোধ ও পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মস্কোর ধারণার চেয়েও শক্ত প্রতিরোধ ও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।”

এখন যদি ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সফলতা পেতে কয়েক মাস সময় প্রয়োজন হয়, তখন কি হবে। রাশিয়ার জনগণ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। অর্থনীতি একবারেই ভেঙ্গে পড়বে। অর্থনীতি ভেঙে পড়লে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

আন্তর্জাতিক বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় থিঙ্কট্যাংক হিসেবে পরিচিত চ্যাথাম হাউজের গবেষক জেমস নিক্সেই সম্প্রতি সিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা থেকেই ইউক্রেনে হামলা শুরু করে দিয়েছেন। পশ্চিমা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে মস্কোর বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেবে- তা হয়তো ভাবেননি। অভিযান শুরুর পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে কিয়েভ দখলের প্রস্তুতি ছিল পুতিনের। অথচ এখন তাকে দীর্ঘ যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হবে যা তার পক্ষে সম্ভব নয়।” ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন যুদ্ধের খরচ বহন করা সহজ হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো একটু নরম হয়েছেন বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। সোমবার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোর সঙ্গে প্রায় দেড় ঘন্টা  টেলিফোনালাপে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে পুতিন তিনটি শর্ত দিয়েছেন।

পুতিন স্পষ্ট করে জানান, ইউক্রেনের সঙ্গে সমঝোতা সম্ভব হবে রাশিয়ার তিন শর্ত মেনে নিলেই। প্রথমত, ক্রিমিয়ায় রুশ শাসনকে স্বীকৃতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিমুদ্রাকরণ এবং তৃতীয়ত, ইউক্রেনের সেনাকে অস্ত্র ছেড়ে দিতে হবে।

ফরাসি প্রেসিডেন্টও তিনটি দাবির কথা তুলে ধরেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপে ম্যাঁক্রোর দাবিগুলো ছিলো: ইউক্রেনের বেসামরিক লোকজন ও আবাসিক এলাকায় সব ধরনের হামলা বন্ধ করা, বেসামরিক অবকাঠামোগুলো রক্ষা করা এবং দেশটির গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ পথগুলোও নিরাপদ করা।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পথে বিশাল সেনাবহর পাঠিয়েছে রাশিয়া। মঙ্গলবারও বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী। একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে নিজ দেশ রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিবাদ, সমালোচনার ঝড়, পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার বোঝা-এমন সব পরিস্থিতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন- তা নিয়েই ভাবছেন বিশ্লেষকেরা। স্ট্রংম্যান যে কখনও মাথা নত করতে চাইবেন না তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেদের দ্বিমত নেই। তবে ঘরে-বাইরের বিপদ কীভাবে সামলাবেন তিনি- তাই দেখার জন্য অপেক্ষায় আছেন বিশ্ববাসী।

লেখক: সাংবাদিক

Link copied!