পুলিশের ‘প্রদীপের’ নীচে কেন এ অন্ধকার

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১, ২০২২, ০৭:৫৪ পিএম

পুলিশের ‘প্রদীপের’ নীচে কেন এ অন্ধকার

একপাশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, অন্যপাশে পাহাড়ের সারি। আর তার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কটি। ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়কটি বর্তমানে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক। সড়কটির পুরোটাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এই মেরিন ড্রাইভই ওসি প্রদীপের মতো কয়েকজন পুলিশের কারণে হয়ে উঠেছিল মরনড্রাইভ তথা ডেথজোন!

পুলিশ বাহিনীর কতিপয় আইনী সদস্যের হাতে বেআইনী বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের বহু ঘটনায় জড়িয়ে গেছে নয়নাভিরাম সৈকত শহর কক্সবাজারের নাম। তবে একটি ঘটনা বদলে দিল অনেক কিছুই। মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যার পর ফেঁসে যান টেকনাফ থানার দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ওসি প্রদীপ। নামে প্রদীপ হলেও তার কর্মকাণ্ড অন্ধকারে ঢাকা। তিনি চাকরিসূত্রে গণমানুষের রক্ষক হয়েও বনে গিয়েছিলেন টেকনাফ তথা কক্সবাজারের অঘোষিত এক অত্যাচারী ভক্ষক রাজা। তার ‘রাজত্বকালে’ টেকনাফ পুলিশ তখন কথায় কথায় লোকজনকে ধরে নিয়ে যেত, ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করতো। স্থানীয়দের ভাষায়, ‘হরেদরে মানুষ মারত’ টেকনাফ থানার পুলিশ। ওসি প্রদীপ ও তার সহকর্মীদের হাতে ‘ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যার’ প্রধান স্পট হয়ে উঠেছিল এই মেরিন ড্রাইভ সড়কটি।

দেশের সবচেয়ে দক্ষিণের বহুল আলোচিত ও মাদকের নিরাপদ রুট হিসেবে বিবেচিত এই টেকনাফ থানা। ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ এই থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন প্রদীপ কুমার দাশ। মাত্র দুই বছরে প্রদীপ হেন অপকর্ম নেই যে তিনি করতে বাকি রেখেছেন! বন্দুকযুদ্ধের নামে ১৭৪ ব্যক্তিকে হত্যা (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের হিসাব), অসংখ্য গুম, দেদার অপহরণ, জমি জবরদখল, ডাকাতের মতো লুটপাট, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, হয়রানি-নির্যাতন, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, প্রথমে আতঙ্ক তৈরি করে পরে ইয়াবা কারবারি ও জলদস্যুদের সঙ্গে আঁতাত, ছোট ইয়াবা কারবারিদের নির্মূল করে বড় কারবারিদের রেহাই দেওয়াসহ সমূহ অপকর্মের সবকিছুই তিনি করেছেন। মাদক নির্মূল করার শপথ নিয়ে নিজেই ওই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। জনগণের সেবা ও রক্ষার জন্য শপথ নেওয়া একজন পুলিশ সদস্য নিজেই ভক্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। এভাবে সামান্য একজন পুলিশ কর্তা হয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এবং পাচার করেছেন।

মানবাধিকার ও সুশাসন ইস্যুতে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানাচ্ছে, ‘সিনহা হত্যার আগে কেন এমন ঘটনা ঘটতো, সে প্রশ্ন এখন জাগতেই পারে। ওই হত্যার পর যদি বন্দুকযুদ্ধ ছাড়াই ইয়াবার বড় চালান ধরা সম্ভব হয়, তাহলে বলতে হয়, এখানে আগে যে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে, সেসবে ব্যক্তিস্বার্থ বা কারও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

অন্যসব হত্যাকাণ্ডের মতো মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডেও ওসি প্রদীপ ধামাচাপা দিতে পারবেন, এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষের বোবাকান্না অভিশাপে পরিণত হয় কখনো কখনো। অবসর নেওয়া সেনা কর্মকর্তা সিনহাকে খুন করে আর পার পেলেন না প্রদীপ। এটি ঠিক যে, একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর বলেই তার হত্যাকাণ্ডে ফেঁসে গেছেন প্রদীপ। না হলে তার সরকারি পিস্তল খাপবন্দি হতো না, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

অথচ প্রদীপ তার এরকম ‘কীর্তির ঝলকানির’ জন্যই কি ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ মেডাল’ বা বিপিএম পেয়েছিলেন? পদকপ্রাপ্তির সাইটেশনে যদিও তার ছয়টি ‘ক্রসফায়ারের ঘটনার’ উল্লেখ ছিল।

আমাদের বিস্মিত হতে হয় একথা ভেবে যে, মেজর সিনহার ওই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত না হলে, মেরিন ড্রাইভে আদৌ সাধারণ মানুষের মৃত্যুমিছিল থামতো কি না? বরঞ্চ আরো কত শত নীরিহ মানুষকে ওসি প্রদীপরা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে থাকতেন। আমাদের আরও বিস্মিত হতে হয় এ কথা ভেবে যে, বন্দুকযুদ্ধ নামের বর্বরোচিত ঘটনায় ১৭৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে কীভাবে এতদিন টিকে থাকলেন প্রদীপ ও তার সহযোগীরা? আর আমাদের মিডিয়াইবা এ রকম বড় সংবাদগুলো তখন কীভাবে এড়িয়ে যেতে পারল বা লিডস্টোরি করতে পারল না!

সমাজের দর্পণ মিডিয়ার তো একটি বড় কাজ হল এরকম গণহত্যার মতো বর্বরতার বিপক্ষে গণমানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করা, জনমত জোয়ার তৈরি করা, সমাজকে শিক্ষিত-সচেতন করে তোলা। বাংলাদেশের মিডিয়া যে এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ব্যর্থতার কারণেই ওসি প্রদীপদের মতো আরও অনেকে একই ধরনের অপকর্মের সুযোগ পাচ্ছেন। প্রশাসনের কতিপয়ের স্খলনের সাথে সাংবাদিকতার স্খলনের যোগসূত্র কেউ আবিস্কার করলেও তাতে অবাক হওয়ার কিছু দেখি না।

একজন-দুজন নয়; দেড় শতাধিক মানুষকে একজন থানার সামান্য ওসি খুন করে ফেলেছেন। তা-ও আবার মাত্র দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে! এই খবর মেইন স্ট্রিম মিডিয়াগুলো দিনের পর দিন এড়িয়ে গেছে! কীভাবে তারা এতদিন নির্বিকার থাকতে পারল! কেউ যদি বলেন যে, মিডিয়ায় ত এসেছে এ সংক্রান্ত কিছু নিউজ! আমি বলব, সিঙ্গেল কলামে কোট-আনকোটের মারপ্যাঁচের ওই বন্দুকযুদ্ধের খবরের মূল্য নেই পাঠকের কাছে। পাঠক চায় ইনভেস্টিগেটিভ-ডিটেইলড নিউজ।

নানা মানবাধিকার ইস্যুতে আমাদের সুশীল সমাজের বিপুল সক্রিয়তা দেখা যায় প্রায়শ। অবাক করা বিষয় হল, এ ক্ষেত্রে সেই সক্রিয়তার দেখা মেলেনি! কারও কোনো বিবৃতিও চোখে পড়েনি।

দিনের পর দিন প্রদীপদের ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো সংঘটিত হলেও খবরে সেভাবে আসেনি। বরং এ দেশের মিডিয়া তখন কথিত নায়ক-নায়িকাদের ব্যক্তিগত জীবন, মধ্যরাত, মদ্যরাত, পঞ্চম বিয়ে, তৃতীয় বিচ্ছেদ, গায়ে হলুদ— এসব গুরুত্বহীন সংবাদ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থেকেছে। পাঠক মাত্রেই বুঝতে পারেন যে, মিডিয়া এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিমুক্ত থাকার অবস্থান নিয়েছে। চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। নায়ক-নায়িকাদের আপডেট-সংবাদ থাকতে কে চায় প্রদীপ বাবুর মতো বাঘের লেজ নিয়ে নাড়াচাড়া করে ঝুঁকির মুখে পড়তে?

তবে মিডিয়ার সবাই যে চালাকির পন্থা নেয়নি, তা ঠিক। মেইনস্ট্রিমের বাইরের কিছু মিডিয়া এবং তাদের কর্মীরা জীবন ঝুঁকি নিয়েও মহান পেশার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। প্রদীপদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে কিছু কিছু সংবাদ ও ফলোআপ দিয়ে গেছেন তারা। তাদের কারণেই আজ প্রদীপ-লিয়াকতরা ফাঁসির আসামীদের বসতঘর কনডেম সেলে বন্দি হয়ে ফাঁসির দিন গুনছেন।

জানা যায়, ওসি প্রদীপের একটি ব্যক্তিগত ডায়েরির সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই ডায়েরিতে প্রদীপের দুই শতাধিক কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য প্রমাণ মিলেছে। দৃশ্যমান বা হিসাবের টাকার বাইরেও যে তার টাকার পাহাড় রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। তবে প্রদীপের ডায়েরিতে এমন কিছু ব্যক্তির নামও পাওয়া গেছে, যাদের প্রদীপ বিভিন্ন সময় মোটা অংকের টাকা দিয়ে তার রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রশাসনের কিছু কর্তাব্যক্তিকে মাসোহারা দেওয়ার কথা ওই ডায়েরিতে লেখাও আছে। প্রদীপ তার অপকর্ম ঢাকতে প্রশাসনের উচ্চস্তরের ওই পদধারীদেরকে ঘুষ দিতেন। তারাই তাকে বেপরোয়া মানুষ খুনের সুযোগ করে দিয়েছেন। তাই অপকর্মের অবাদ সুযোগ করে দেওয়ার লাইসেন্সদাতা হিসেবে পাপের দায় তাদের ওপরও বর্তায়। এখন তাদের পরিচয় প্রকাশ করার সময় এসেছে। আশা করি (আশা করতে তো আর দোষ নেই) সরকার এবার সেই রাঘব বোয়ালদের ধরবে।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট। ইমেইল: lutforrahmanhimel@gmail.com

Link copied!