মাত্র এক শতক আগেও যে খেলা লোকে তেমন একটা চিনত না, যে খেলা নিয়ে তেমন আগ্রহও ছিল না কারো; সেই ফুটবল খেলা তত দিনে জনতার খেলা হয়ে উঠল। বায়ুপূর্ণ এক পদগোলককে পদাঘাতে খেলার সাধারণ নাম যে ফুটবল, সেই খেলা পৃথিবীর দিকে দিকে মহা উৎসাহ সৃষ্টি করে ছড়িয়ে পড়ল! সেই খেলাকে কেন্দ্র করে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল তখন অনেকেই। তবে একজন বোধ করি ছাপিয়ে গেলেন সবাইকে। তিনি পেলে। তিনি এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। তিনি ক্রীড়াপ্রেমীদের ভালোবাসার কালোমানিক।
এই কালোমানিক ফুটবলকে এতটাই জনপ্রিয় করে তুললেন যে খোদ ফুটবলই তাঁর কাছে ঋণী হয়ে গেল! সেই ফুটবলে ভর করে পেলে হয়ে উঠলেন সময়ের নায়ক। তিনি না খেললে এটি স্রেফ একটি খেলা হয়েই থাকতো ক্রীড়ার ইতিহাসে। বিশ্বব্যাপী সর্বগ্রাসী এমন জনপ্রিয়তা হয়তো আর পেত না পদগোলক দিয়ে সৃষ্ট আনন্দদায়ী খেলাটি। ফুটবল যে আজকের ফুটবল, সেটিও হয়তো আর হয়ে উঠতো না। কিন্তু বিধির বিধানে সে রকমটি লেখা ছিল না বলেই তিনি একজন পেলেকে পাঠিয়েছিলেন এই ধরাধামে।
স্বপ্নের আরাধ্য বিশ্বকাপ জুলে রিমে ট্রফি হাতে। ছবি: সংগৃহীত
ফুটবলে হয়তো জনতা দুই ভাগ হয়ে খেলা দেখে, কিন্তু পেলের মতো মহানায়কেরা শুধু মাঠ নয়, মাঠের বাইরের ভেদাভেদও ভুলিয়ে দেন। ফুটবলের মাঠে থাকা মানুষেরা অস্থির সময় ভুলে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য শক্তি ও মনোবল বাড়িয়ে নেন। যে কারণে ফুটবল এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এক খেলার নাম।
এই খেলার বিশ্ব প্রতিযোগিতার ইতিহাস গত শতকের তৃতীয় দশকে। জনপ্রিয় খেলাটির বিশ্বকাপ আসরটি প্রথমবারের মতো বসেছিল লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়েতে, ১৯৩০ সালে। এরই দশ বছর পর জন্ম হয় ফুটবল বিস্ময় পেলের। যে বালকটি সেদিন জন্ম নিয়েছিল সাও পাওলোর এক হতদরিদ্র পরিবারে, সে-ই একদিন পরিণত হয়ে যান ফুটবলেরই সবচেয়ে বড় পোষ্টারে। যে খেলাটির আশ্রয়ে তিনি যশখ্যাতি পেলেন, সেই খেলাকেই তিনি দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে অমর করে দিলেন।
যাঁরা খেলেন, তাঁরা খেলোয়াড়। খেলোয়াড়দের কাজ খেলা করা। এই খেলা খেলতে গিয়ে কেউ কেউ খেলার সমার্থক হয়ে যান, সেই খেলাটাকেও ছাড়িয়ে যান তাঁরা। ক্রিকেটে যেমন ডন ব্র্যাডম্যান। বক্সিংয়ে যেমন মোহম্মদ আলি। ফুটবলে তেমনই পেলে।
বিশ্বকাপজয়ী নায়ক পেলেকে উচুতে তুলে ধরেছেন সতীর্থরা। ছবি: সংগৃহীত
ইতিহাসের পথ ধরে কিংবদন্তি গ্যারিঞ্চা, ভাভা, দিদারা এসেছেন। কীর্তি গড়েছেন। মারাদোনা, মেসি, রোনাল্ডোরা এসেছেন। কিংবদন্তি হয়েছেন। কিন্তু খেলার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি তাঁরা। পেলে ফুটবল খেলার সমার্থক হয়েছেন, খেলারও উপরে উঠে গেছেন, এই খেলাকে ছাপিয়ে গেছেন। এই খেলাকে পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিতে প্রভাব রেখেছেন। ফলে খোদ এই খেলাটি নিজেও এখন তাঁর কাছে ঋণী হয়ে গেছে।
পেলেকে দেখার জন্য থেমে গিয়েছে যুদ্ধ। মুছে গিয়েছে সামাজিক ভেদাভেদ। দুঃখ, যন্ত্রণা এমনকি প্রিয়জনের মৃত্যু ভুলেও ছুটে এসেছেন অগুণতি মানুষ। জন্মভূমিতে পেলে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষিত হয়েছেন। দেশের দুর্নীতি মুছতে ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়েছে তাঁকে। ফুটবল আসলে সেতু ছিল তাঁর। ফুটবল দিয়ে জীবন বদলের গানই শুনিয়েছেন পেলে। তিনি বলতেন, তাঁর জন্মই হয়েছে ফুটবল খেলার জন্য, যেমনটা বেথোভেনের জন্ম হয়েছিল সুর সৃষ্টির জন্য।
বাবা ডোনডিনহোর সাথে কোনো এক আড্ডায়। ছবি: সংগৃহীত
মূলতঃ পেলেই বেছে নিয়েছিলেন ফুটবলকে। এই পৃথিবীর অসংখ্য স্টেডিয়াম, খেলার মাঠ, অগণিত ভক্ত, এই খেলাটাতে স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়ার জন্য। একটা আস্ত পৃথিবী তৈরি করার জন্য। যে পৃথিবীর নাম— পেলে’জ় ওয়ার্ল্ড! পেলে সেই সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি।
পেলে, যিনি খালিপায়ে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ জয় করে বিজয়ীর বেশে উঠে আসা একজন। তিনি জন্মভূমি ব্রাজিলের প্রথম আধুনিক কালো জাতীয় নায়ক। ১৯৫৮ সালের সুইডেনে বিশ্বকাপে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বমঞ্চে যাঁর উত্থান। এরপর তিনি কেবল তিনটি বিশ্বকাপই জেতেননি— তিনি যখন ফুটবল মঞ্চে এসেছিলেন, সেটি ছিল ফুটবলে নতুন কিছু। সেই নতুনেরই লিগ্যাসি বা পরম্পরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলেছে আজকের ফুটবল।
আরেক কিংবদন্তি মারাদোনার সাথে। ছবি: সংগৃহীত
এসব কারণেই আরেক গ্রেট ফুটবলার মারাদোনা বলেছেন, ‘পেলেকে নিয়ে বলার কিছু নেই। সে আসলে শরীরের সব অংশ দিয়েই গোল করতে পারে।’আধুনিক যুগের তরুণ সেনসেশন ফুটবলাররা তাই একসুরে বলছেন, ‘আমরা ফুটবলে এখন যা যা করি বা করার চেষ্টা করি, সব আসলে পেলে আগেই করে ফেলেছেন। এখন এ কালের আমরা পেলের সেসব কৌশল আর কারিকুরিগুলো চর্চা করে চলেছি।’
তীব্র গতি, ভীষণ শক্তিশালী, ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, পরিস্থিতি অনুযায়ী মুহূর্তে নিজেকে পাল্টে ফেলা, আকন্ঠ টিমম্যান— মাঠ ও মাঠের বাইরে পেলে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই ক’টা শব্দই গত ষাট বছর ধরে ব্যবহার করেছেন ফুটবল ভক্ত থেকে বিশেষজ্ঞরা। বাবা ফুটবলার হলেও অসম্ভব দারিদ্র ঠেলে সাফল্যের এভারেস্টে উঠেছিলেন পেলে।
পেলে তাই কিংবদন্তিরও উর্ধ্বে। শুধু ফুটবল দিয়ে পেলেকে মাপা যায় না। মহানায়কের মঞ্চে উঠে দাঁড়ানো পেলের জীবনের ছত্রে ছত্রে রয়ে গিয়েছে লড়াই। হারিয়ে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। যে পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষই দরিদ্র, পেলে সেই দারিদ্রের গল্পকে স্বপ্নের মোড়কে পেশ করেছিলেন দুনিয়ার সামনে। চায়ের দোকানে কাজ করা একটা বাচ্চা ছেলের ফুটবল পায়ে দৌঁড়, গোলের উদযাপন, বিশ্বকাপে চুম্বন আবেগে-অনুষঙ্গে ঢুকে পড়েছিল ব্রাজিলের. একই সাথে বিশ্বেরও।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে। ছবি: সংগৃহীত
দারিদ্র জয় করে বিশ্বে শত কোটি দরিদ্র মানুষের আইডল যখন পেলে, তখন একদিকে ফুটবল চাইছে পেলেকে, আর ইউরোপিয়ান টিমগুলো খুঁজছে ব্রাজিলিয়ান তারকাকে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি বড় টিম পেলের পিছনে তখন ছুটেছে টাকার থলি নিয়ে। পেলে নিজ দেশের ক্লাব স্যান্টোস ছেড়ে চলে যাননি। সেই সময়ের বাস্তবতায় দেশীয় ফুটবলকে বাঁচাতে ব্রাজিলের সরকার পেলেকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করে দেয়। ওই সিদ্ধান্তে আরও একটি সত্য পরিষ্কার হয়েছিল, পেলেকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না!
পেলে এভাবে নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। যাঁর উঠে আসার গল্প মিথের চেয়েও মোহনীয় এবং মোহময়! তিনি এমনই এক মোহমায়া, যাঁর আবেশে এককালে বুঁদ হয়ে ছিল গোটা দুনিয়া। যাঁর রেশ এখনো আছে, আর রয়ে যাবে আরও শতসহস্র বর্ষ। এর আগে হয়তো এই পৃথিবী দেখেছে বহু বীরের বীরত্বগাঁথা, কিন্তু গোটা পৃথিবী এমন নতজানু হয়ে সম্মান জানিয়েছে, ভালোবাসায় আপন করে নিয়েছে, আত্মার আত্মীয় হিসেবে মেনে নিয়েছে—এমনটি আর কারোর ক্ষেত্রে হয়নি। তিনি পেলে। তিনি এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। ফুটবলপাগল জনতার কালোমানিক!
পেলে ফুটবলের রাজা। তাঁর আসন কেউ কোনোদিন নিতে পারবে না। ছবি: সংগৃহীত
একবার পেলেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কে বেশি জনপ্রিয়— আপনি, নাকি যিশুখ্রিষ্ট? এমন প্রশ্ন শুনে নাকি স্মিত হেসে পেলে মজার ছলে জবাব দিয়েছিলেন, এই দুনিয়ার অনেক কোণে যিশুর নাম লোকে এখনো জানে না।
পেলে বিনয়ের আবহে ওইটুকু জবাব দিলেও আমরা জানি, যিশুর চেয়েও বেশি মানুষ পেলের নাম জানে। যিশুর চেয়েও বেশি জনপ্রিয় তিনি। যাঁর উপস্থিতি যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার গল্পের মতোই শক্তিশালী। বিশ্বকাঁপানো ফুটবলের রাজা যে তিনি। বিশ্বায়নের যুগের সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সুপারহিরোও তিনি। ফুটবলের বিশ্বনিয়ন্ত্রক সংস্থা এ কারণেই তাঁর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে বলছে, পেলে রাজা। তাঁর আসন কেউ কখনো নিতে পারবে না।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট