হেনরিক যোহান ইবসেন একজন নরওয়েজীয় নাট্যকার, কবি ও মঞ্চনাটক পরিচালক। বলা হয়ে থাকে তাঁর হাত ধরেই আধুনিক বাস্তবতাবাদী নাটকের সূত্রপাত ঘটেছে । তাকে আধুনিক নাটকের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি নরওয়ের জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
নরওয়ের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেখক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার হেনরিক যোহান ইবসেন ১৮২৮ সালের ২০ মার্চ নরওয়ের স্কিয়েনে জম্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নুড ইবসেন ও মা ম্যারিচেন অ্যাটেনবার্গ।
১৫ বছর বয়সে ফার্মাসিস্ট হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ছোট্ট শহর গ্রিমস্টাডে যান। সেখানেই তার নাটক লেখার সূত্রপাত। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ক্রিস্টিয়ানিয়ায় (বর্তমান অসলো) যান। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তখন নাটক রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।
এ সময় সাংবাদিকতা করে টুকটাক আয় করতে থাকেন। ১৮৫০ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘ক্যাটিলিনা’ ব্রাইনজুল্ফ বিজারম ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। ওই বছর প্রথমবারের মতো মঞ্চায়িত হয় ‘দ্য বুরিয়াল মন্ড’। কিন্তু এটি দর্শক ও সমালোচকদের খুব একটা নজর কাড়তে পারেনি।
পরে বার্গেনের একটি নরওয়েজীয় নাট্যগোষ্ঠীতে কয়েক বছর চাকরি করেন। সেখানে তিনি ১৪৫টিরও বেশি নাটকে নাট্যকার, পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। ১৮৫৮ সালে ক্রিস্টিয়ানিয়াতে ফিরে জাতীয় থিয়েটারের সৃজন পরিচালক নিযুক্ত হন। কিন্তু সময়টা ছিল আর্থিকভাবে হতাশাজনক। ১৮৬৪ সালে ক্রিস্টানিয়া ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ইতালি চলে যান।
ইতালিতে বসে লেখেন নাটক ‘ব্র্যান্ড’। একজন যাজকের বিয়োগাত্মক ঘটনা নিয়ে নাটকটি রচিত। নাটকটি সমালোচকদের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এতদিন পর যেন তার লেখক জীবনের সার্থকতা পেতে শুরু করেন। এই নাটকের মধ্য দিয়ে তার পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতাও আসতে থাকে। তার এই নাটক স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় ব্যাপক সফলতা পায়।
এ সময় তার কাজকে অনেকে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক কিয়েরকেগার্ডের দর্শনের সঙ্গে তুলনা করেন। পরের সময়গুলোকে বলা যায় ইবসেনের স্বর্ণযুগ। দু’বছর পর প্রকাশ করেন নাটক ‘পিয়ার গিন্ট’। এই নাটকটি ইবসেনের নাট্য জীবনের অন্যতম সেরা কাজ বলে অনেকের অভিমত। গ্রিক মহাকাব্যের আধুনিক উপস্থাপন করা হয় নাটকটিতে, মঞ্চে নাটকটিতে সুরারোপ করেন জনপ্রিয় সুরকার এডভার্ড গ্রেগ। পরপর দুটি নাটকই ভীষণ খ্যাতি অর্জন করে। তিনি থিয়েটার পাগল মানুষদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।
১৮৬৮ সালে ইতালি ছেড়ে জার্মানির ড্রেসডেনে যান।মিউনিখের এক মঞ্চে তার লেখা ‘দ্য পিলারস সোসাইটি’ নামে সমাজ জীবনের চালচিত্র নিয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন যা দর্শক মহল থেকে শুরু করে শিল্প মহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। এই নাটকটি পরবর্তীকালে তার নাট্যচর্চায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। তার আগের জনপ্রিয় দুটি নাটকেই ছিল গীতিনাট্যের প্রভাব। এই নাটক থেকেই তিনি গীতিনাট্যের ধারা থেকে বের হয়ে এসে গদ্যধর্মী নাটক লেখাতে মনোনিবেশ করেন, যার সার্থক প্রয়াস ‘দ্য পিলারস সোসাইটি’।
১৮৭৫ সালে মিউনিখে চলে যান এবং সেখানে ১৮৭৯ সালে প্রকাশ করেন বিখ্যাত `আ ডলস হাউস’। এটি বিশ্বে রচিত বিভিন্ন নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক হিসেবে স্থান পেয়েছিল। ঐ বছরের ২১ ডিসেম্বর বড়দিন উপলক্ষে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের রয়েল থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ করা হয়। এই নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অন্ধকার দিকগুলোকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং অপূর্ব শৈলীতে নারীদের অবস্থা ও তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরেন।
নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে নোরা নামের একজন নারী। ঊনবিংশ শতাব্দীর এক পরিবারকে কেন্দ্র করে নাটকটি আবর্তিত হয়।পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় একজন নারী কখনোই নিজের মতো করে বাস করতে পারে না। প্রতিনিয়ত তাকে সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলায় আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়। সমাজে তার বিশ্বাস, ভালোবাসা ও সততার কোনো মূল্য নেই। এই নাটকের মধ্য দিয়ে সেই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইবসেনের তীব্র ধিক্কার জানান। নারী অধিকার আন্দোলনে এই নাটক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে তার কপালে জুটে রাজকীয় নানা সম্মান। ২০০১ সালে ইবসেনের স্বাক্ষর সংবলিত ‘অ্যা ডলস হাউস’ নাটকের পাণ্ডুলিপিকে ইউনেস্কো এক ঐতিহাসিক দলিল বিবেচনায় ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এর অন্তর্ভুক্ত করে।
১৮৮১ সালে ‘গোস্টস’ এবং ১৮৮২ সালে ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’ নাটক দুটিও দর্শকমহল ও সুধীমহলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পায়। এর পরপরই হেনরিক ইবসেনের সাড়া জাগানো নাটকগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। কিন্তু কোনোকিছুই তার বিষণ্নতা ঢাকতে পারেনি।
ইবসেন কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা ইউরোপীয় নাট্য ঐতিহ্যের বিপরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার নাটকের প্রধান বিষয় ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার স্খলন ও সঙ্কট। প্রথমদিকে শুধু ব্যক্তি মানুষের সঙ্কট ঠাঁই পেলেও পরবর্তীতে অন্তর্ভুক্ত হয় ইতিহাস ও সমাজ কাঠামো। নাটকের মাধ্যমে তিনি প্রচলিত বিমূর্ত বিশ্বাস ও আচারগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানান। এ ছাড়া তার নাটকে রয়েছে পরাবাস্তব বিষয়াদি। যা আসলে দ্বন্দ্বময় বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে।
তার অন্যান্য বিখ্যাত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পিয়ার গিন্ট (১৮৬৭), গোস্টস (১৮৮১), অন এনিমি অফ দ্য পিপল (১৮৮২), দ্য ওয়াইল্ড ডাক (১৮৮৪), দ্য লেডি ফ্রম দ্য সি (১৮৮৮), হেডা গ্যাবলার (১৮৯০), হন গাব্রিয়েল বোর্কমান (১৮৯৬) এবং হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন (১৮৯৯)। এ ছাড়া রয়েছে তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ডিজিতে (১৮৬২)।
ইবসেনের ‘আ ডলস হাউস’ বিশ শতকে সবচেয়ে বেশিবার মঞ্চায়িত নাটক। তার বিভিন্ন নাটকে ফুটে উঠেছে সমাজের নানা অসঙ্গতি, বঞ্চনা, পুরুষশাসিত সমাজে নিষ্পেষিত নারীদের তীব্র সংগ্রাম। নারী অধিকার ও নারী ব্যক্তিত্বের উন্মেষ তার নাটকের প্রধান উপজীব্য বিষয়।
তিনি পরবর্তীকালের জর্জ বানার্ড শ, অস্কার ওয়াইল্ড, আর্থার মিলার, জেমস জয়েস, ইউজিন ও’নিল এবং মিরোসলব করলিজার মতো বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও নাট্যকারদের প্রভাবিত করেছেন।
বার্নার্ড শ প্রথম তার নাটকের সার্থক মূল্যায়ন করেছিলেন। সমালোচক M. Block বলেছিলেন “Modern Drama begins with Ibsen”।
তার বেশক’টি নাটক বাংলাদেশের অনুদিত ও মঞ্চায়িত হয়েছে। অনুদিত নাটকের মধ্যে বই আকারে পাওয়া যায়- আ ডলস হাউস, ওয়াইল্ড ডার্ক, এন এনিমি অব দ্য পিপল, রোজমারশোম, হেডা গ্যাবলার, জন গ্যাব্রিয়েল বোর্কম্যান এবং হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন। এ ছাড়া তার নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
১৯০৬ সালের ২৩ মে ক্রিস্টিয়ানিয়ায় হেনরিক যোহান ইবসেন মৃত্যুবরণ করেন।