“কয়েদ-এ-হায়াত ওয়া বন্দ-এ-গাম আসল্ মে দুনো এক হ্যায়,
মওতসে পেহলে আদমি গাম সে নাজাত পায়ে কিউ?”
জীবনের কয়েদখানা, দুঃখের বন্দীত্ব উভয়ই তো একই/তাহলে, মৃত্যুর আগে মানুষ আর দুঃখ থেকে মুক্তি পায় কই?-মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব।
যিনি মির্জা গালিব নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। যিনি মসজিদে বসে শরাব পান করেন। শরাব পানে বাঁধাদানকারীদের জাহিল বা মূর্খ নামে অভিহিত করেন। তবে তিনি আদৌ মসজিদে বসে শরাব পান করেন নাকি তা রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয় তা বিতর্কের। তবে তার কাছে যে মানুষই আসল, মানুষই সত্য এটি আর অপ্রকাশিত থাকে না। কেননা, তিনি মুসল্লীদের জিজ্ঞেস করেন, এমন একটা জায়গা দেখাও যেখানে খোদা নেই। তিনি বলেন,
জাহিল, শরাব পিনে দে
মসজিদ মে ব্যায়ঠ কার,
ইয়া ও জাগা বাতা
যাঁহা খুদা নেহি।'- এরপর আরও তর্ক বিতর্ক হতে থাকে কবি এবং মুসল্লিদের। যেখানে গালিব বলেন, দুনিয়ার এমন কোন জায়গা নেই যেখানে খোদার অস্তত্বি নেই। এমনকি মানুষের অন্তরেও যে খোদা সদা বিদ্যমান মানুষ সেটা ভুলে গিয়ে খোদাকে বাইরে অন্যকিছুতে খুঁজে বেড়ায়।
মির্জা গালিব মানুষের অস্তিত্ব সচেতন এক ব্যক্তিত্ব। তাই তো তিনি খোদাকে তার সঙ্গে উপস্থিত রেখেই মদ্যপান করেন। তার উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক করেন। একমুখী জীবনযাপনকারীদের তীব্র ভর্ৎসনা করে তাদের জাহিল বা মূর্খে বলে সম্বোধন করেন এবং কোন বাতুল আলাপ নয় যুক্তিবোধ দিয়ে তিনি মানুষের মনের আগল খুলতে চান।
মির্জা গালিব কি আগাগোড়াই প্রেমের কবি? তার কবিতায় আচ্ছন্ন হয়নি ভারতীয় উপমহাদেশে এমন যুবক-যুবতীর সংখ্যা কম নয়। কেবল যুবক-যুবতী কেন, বলিউড কি তার গজল-গানে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেনি? উপমহাদেশে সঙ্গীতের পুরোধা জগজিৎ সিং, মেহদি হাসান, মোহাম্মদ রফি, গুলাম আলী, গুলজার কিংবা রাহাত ফতেহ আলী খানও ব্যবহার করেছেন তার পঙক্তি। বিভিন্ন আসরে গেয়েছেন সমৃদ্ধ সব গজল।
তার চেয়ে বড় কথা, গালিব একটি যুগ সন্ধিক্ষণের সচেতন সাক্ষী। মোঘল সাম্রাজ্যের পতন, কোম্পানি শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম-সব ঘটনাকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে। নাটকীয় সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গালিবের জীবন যেন তার লেখা কবিতার চেয়েও নাটকীয়।
যৌবনের প্রারম্ভে প্রেমে পড়েছিলেন এক ডোমনী; গায়িকা ও নর্তকীর। কিন্তু সমাজ মেনে নেবে না, সেই ভয়ে সম্ভবত গালিবের সেই প্রেমিকা আত্মহত্যা করেছিলেন। যদিও সেসময়কার সমাজে উপপত্নী কিংবা একাধিক পত্নী রাখা খারার দৃষ্টিতে দেখা হতো না। কিন্তু কোন এক আজানা কারণে গালিব এবং তার প্রেমিকার মিলন হয়নি। তার এই বিচ্ছেদ তাকে আজীবন পুড়িয়েছে। তার প্রেমিকা মারা যাওয়ার পর গালিব লিখেছেন,
`যদি দুঃখ-বেদনা সইতে নাই পার
তাহলে কেন সমব্যাথি হয়েছিলে?'
আরও লিখেছেন,
`তোমার রূপ-লাবণ্য পুষ্প-দাম কোথায়?
হায়, তুমি যে সব মিশিয়ে দিয়েছো ধুলায়!'
-আহ! কি প্রেম। প্রিয়া তার জীবনে আসেননি সেই দুঃখ তাকে আজীবন কাঁদিয়েছে। সেই না পাওয়া প্রেমিক নিয়ে কম কাব্য, রুবাইয়াৎ, শের লিখেননি গালিব। তার দুঃখ আরও বাড়ে যখন তিনি মুঘল দরবার ত্যাগ করেন। তীব্র অর্থ কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করেন- একসময়কার ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান গালিব। জীবনের এক পর্যায়ে জীবনে তীব্র কষ্ট পেয়ে গালিব লিখেন,
“ইয়ে না থি হামারি কিসমাত্ কি বিসাল-এ ইয়ার হোতা,
আগার অওর জিতে রেহতে ইয়েহি ইনতেজার হোতা।”
-প্রিয়ার সাথে মিলন হবে; এ আসলে ভাগ্যেই ছিল না।
আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে, অপেক্ষাটাই দীর্ঘতর হতো শুধু
বেঁচে থাকা আর হতো না।
কিন্তু গালিব মরে গিয়েও মরেননি। আগ্রায় জন্ম নেওয়া এই কবির শের বারবার মানুষের প্রেমের উপাদান হয়ে থেকেছে। কিন্তু গালিব জীবনে প্রেম পাননি। সেই প্রেম ফিরে পাওয়ার ব্যকুল বাসনায় তাই বারবার প্রিয়ার কথা স্মরণ করে লিখেছেন,
জী ঢুন্ড তাহে ফির ওয়াহি ফুরসতকে রাত দিন
বেইঠে রহে তসবৌরে জানা কিয়ে হুয়ে
-হৃদয় খুঁজে ফেরে সেই ছুটির রাতদিন
যখন প্রিয়ার ভাবনায় বসে থাকতাম অন্তহীন।
গালিব তার সমকালীন সময়কে পাঠ করতে পেরেছিলেন। এগিয়ে গিয়েছিলেন সময়ের চেয়ে। যেন ধরতে পেরেছিলেন শতবর্ষ পরের ভারতবর্ষের সমাজচিত্র। তাই লিখতে পেরেছিলেন, ‘জাহিল শরাব পি নে দে মাসজিদ মে ব্যাঠ কার…’-এর মতো বিদ্রোহী উচ্চারণ। মানুষ ছিলেন গালিব, মানুষ থাকারই শপথ ছিল তার। তবে উচ্চবংশীয় হওয়ায় আচরণে কিছুটা ঔদ্ধত্যও ছিল তার। ১৮৩৭ সালে মোঘল সম্রাট আকবর শাহ মারা গেলে তার দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর সম্রাট হন। তবে এর আগেই অর্থ্যাৎ, আকবর শাহের আমলেই গালিব মোঘল রাজদরবারে পরিচিত। পরে উর্দু জানা এবং উর্দু সাহিত্যের সমঝদার এবং চর্চাকারী হিসেবে বাহদুর শাহের আনুকূল্য লাভে ব্যর্থ হন গালিব। এক্ষেত্রে তার বিরোধীতা করেন, তারই নিজ সম্প্রদায়। আরকেটি বাঁধা ছিল, তিনি এর আগের সম্রাট আকবর শাহ এবং তার পুত্র সেলিমের স্তুতি করে ‘ক্বাসিদা’ লিখেছিলেন। এর কারণে বাহাদুর শাহ জাফরের বিরাগভাজন হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু পরে তিনি বাহাদুর শাহের দরবারে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু তার সেই সৌভাগ্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কেননা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ সেই সুখে ছেদ টানে।
যাইহোক পিতৃবৎ অভিভাবক চাচা নাসরুল্লাহ খানের মৃত্যুতে আর্থিক উৎস সংকুচিত হয়।অল্প বয়সে পিতার প্রস্থান, যৌবনের প্রারম্ভে প্রেয়সী বিয়োগ, জীবনভরের আর্থিক কষ্ট গালিবকে পুড়িয়েছে। এমতাবস্থায় রাজ আনুকূল্য তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু তেমনটা হয়নি। ফলে, তার প্রায় ধ্বসে যাওয়া আত্মবিশ্বাস এবং আর্থিক অবস্থানের কারণে তাকে বারবার ভুগতে হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসন শুরু, মোঘল শাসন এবং সংস্কৃতির ধ্বসে পড়া সবই গালিবকে অস্থির করে রেখেছে আজীবন। স্পর্শকাতর মনের অধিকারী গালিব এই অস্থিরতা থেকে কোনদিন মুক্তি পাননি। এর ছাপ পড়েছে তার সাহিত্য চর্চায়ও। কিন্তু তারপরও তার সৃষ্টির কারণেই তিনি উপমহাদেশের সর্বজনগ্রাহ্য এক বিরহী-উদ্ধত সাহিত্যিক ‘মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব’।