ম্যারাডোনা : ইশ্বরের প্রতারণা ও সর্বকালের সেরা বিতর্ক

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ২৫, ২০২১, ০৭:৩৮ এএম

ম্যারাডোনা : ইশ্বরের প্রতারণা ও সর্বকালের সেরা বিতর্ক

সর্বকালের সেরা এই বিষয় নির্ধারনের দুটি পদ্ধতি আছে। এক বিশেষজ্ঞ মতামত ও সাধারণ জনগণের ভোটে নির্বাচন করা। ফুটবলের ইতিহাসে অল্প কিছু খেলোয়াড় আছেন যারা কিনা দক্ষ বিচারক আর সাধারণ জনগণ দু’দিকের ভোটেই প্রথম দিকেই থাকেন। এরকম একজন খেলোয়াড় হচ্ছেন দিয়াগো ম্যারাডোনা। কিন্তু ফুটবল ইতিহাসের সেরা বিতর্কর তালিকা করতে গেলেও সকলের ওপরের কাতারেই থাকবে ম্যারাডোনা।

সর্বকালের সেরা বিতর্ক ও সেরা গোলের জন্ম একসাথেই

১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ড। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে দুপক্ষের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে। উত্তেজনাকর ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত ও অন্যতম সেরা ঘটনার জন্ম দেয়। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ম্যারাডোনা খেলার ৫১তম মিনিটে একটি গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। কিন্তু পরে টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা যায়, গোলটি করার সময় ম্যারাডোনা হাত ব্যবহার করেন। হাত দিয়ে বলে আঘাত করে তিনি সেটিকে গোলপোস্টের দিকে ঠেলে দেন। ম্যারাডোনা নিজেও পরে স্বীকার করেছিলেন।

ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটন সঙ্গে সঙ্গেই অনেক প্রতিবাদ করেছিলেন। চার-পাঁচজন ইংলিশ ফুটবলার গোল বাতিলের দাবি জানিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন রেফারির দিকে। কিন্তু ব্যাপারটি রেফারি সত্যিই বুঝে উঠতে পারেননি। অন্যদিকে ম্যারাডোনাও সতীর্থদের সঙ্গে এমনভাবে গোল উদযাপনে মেতে ওঠেন যে সেটি বাতিল করার চিন্তাও আসেনি কারো মাথায়।

এমন বিতর্কিত গোলের ঠিক চার মিনিট পরেই দ্বিতীয় গোল করেন এই আর্জেন্টাইন তারকা। যে গোলকে পরে ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করে। মাঠের অর্ধেকের বেশি অংশ দৌড়ে পাঁচজন ইংলিশ ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে কাটিয়ে গোল করেন ম্যারাডোনা। ২০০২ সালে ফিফা অনলাইনে ভোটের আয়োজন করলে এই গোলটি ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হিসেবে নির্বাচিত হয়। কিন্তু সব ছাপিয়ে বিতর্কিত হয়ে আছে ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বরের হাতের’ গোল।

সেরা নির্বাচনের পদ্ধতি পাল্টিয়েছে ফিফা

সেরা বাছাইয়ের দক্ষ লোক দিয়ে নির্বাচন করাটাই নিঃসন্দেহে বেশি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কিন্তু এর সাথে সাথে সাধারণ মানুষের নির্বাচনকেও অবজ্ঞা করা যায় না। সাধারণ মানুষের নির্বাচনে মূলত দুটো সমস্যা হয়। একটি হচ্ছে, তারা আবেগের আশ্রয় বেশি নেয়; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সমসাময়িকদের এগিয়ে রাখে। 

গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করার সময় ফিফা প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়, ইন্টারনেটে ভোটিংয়ের মাধ্যমে সেরা নির্বাচন করা হবে। সেভাবে ভোটিংও হয়। তবে ফলাফল দেখে ফিফা কমিটি চোখে সর্ষে ফুল দেখে। ম্যারাডোনা ভোট পান ৫৩.৬%, পক্ষান্তরে পেলে পান মাত্র ১৮.৫৩%।

এরপরই ফিফা আরেকটি কমিটি গঠন করে, যেখানে ভোট গ্রহণ করা হয় তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ও ম্যাগাজিনের পাঠক আর জুরি বোর্ডের সদস্যদের কাছ থেকে। এই নির্বাচনে পেলে প্রথম হন। শেষ পর্যন্ত গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের দুটো পুরষ্কার দেওয়া হয়; একটি জনগনের সেরা, আরেকটি বিশেষজ্ঞদের সেরা।

শুধু ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তার কারনেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল ফিফাকে। তবে  

২০০৫ সালের ২২ আগস্ট এক টেলিভিশন শোতে এসে ম্যারাডোনা পুরনো বিতর্ক উসকে দেন। ওই প্রোগ্রামে তিনি স্বীকার করেন, বলে তার মাথা ছোঁয়নি, বরং হাত লেগেছে। তবে তার সুকৌশলী উত্তর ছিল এমন, ‘ম্যারাডোনার খানিকটা মাথা আর ঈশ্বরের খানিকটা হাত, এ দিয়েই গোল!’

ইশ্বরের মতই মান্য করে

ইতালির নাপোলিবাসীকে যদি জিজ্ঞাস করা হয় তাদের ইশ্বর কে। তৎক্ষণাৎ আঙ্গুল তুলে গলি বা দেয়ালে নীল জার্সি পরা একজনকেই দেখিয়ে দেয়। স্বয়ং ম্যারাডোনা ইশ্বরতুল্য নাপোলিবাসীর আছে। বিশ্বের সেরা দ্বৈরথ যে দুই দলের সমর্থক তারাও একে অপরকে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন ম্যারাডোনার প্রস্থানে। 

ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলি কখনোই ইতালির শীর্ষ ক্লাবের একটি ছিল না। ম্যারাডোনা আসার আগে কখনো লিগও জিততে পারেনি তারা। ১৯৬৮ এবং ১৯৭৫ সালে রানারআপ হওয়াই ছিল তখন পর্যন্ত তাদের সেরা সাফল্য। তবে ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে তারা চলে যায় পয়েন্ট তালিকার ১২ নম্বর পজিশনে। মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য রেলিগেশন থেকে বেঁচে যায় ক্লাবটি। এরকম এক ক্লাবে ম্যারাডোনার মতো খেলোয়াড়ের আগমন কিছুটা বিস্ময়েরই। প্রথম মৌসুমে ম্যারাডোনা ১৪ গোল করলেও দুর্বল ডিফেন্সের কারণে নাপোলি লিগে ৮ম হয়। এর পরের মৌসুমে ম্যারাডোনা দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ১১টি গোল করেন, সাথে নাপোলি উঠে আসে লিগ টেবিলের ৩ নম্বরে।

পরের মৌসুমে নাপোলি জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফিরে আসে। বিশ্বকাপজয়ী ম্যারাডোনাও দলকে নিয়ে নতুন ভাবে নামেন মাঠে। আর এই মৌসুমেই নাপোলি লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, যা তাদের ক্লাব ইতিহাসে প্রথম। এছাড়া ম্যারাডোনা থাকাকালীন তারা আরো একবার লিগ জেতে। একটি কোপা ইতালিয়া, উয়েফা কাপ আর একটি ইতালিয়ান সুপারকোপাও জেতে তারা। মাঝে ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে ম্যারাডোনা লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।

নাপোলিতে ৭ মৌসুম খেলে মাত্র ৫টি ট্রফি জয়কে আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ অর্জন মনে হতে পারে। কিন্তু আপনি জেনে বিস্মিত হবেন যে, ম্যারাডোনা থাকাকালীন যে দু’বার নাপোলি লিগ শিরোপা জিতেছে, সেটাই তাদের একমাত্র অর্জন হয়ে রয়েছে। নাপোলি তাদের ইতিহাসে সর্বমোট ১০টি মেজর শিরোপা জিতেছে ,যার ৫টিই ম্যারাডোনার আমলে। আর নাপোলির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতাও ম্যারাডোনাই!

নাপোলির ইতিহাসে ম্যারাডোনার অবদান কী, সেটা বোঝার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট। ম্যারাডোনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নাপোলি তাদের ১০ নম্বর জার্সিটিকে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে, এই জার্সি পরেই সেখানে খেলতেন ইতিহাসের এই জাদুময় ফুটবলার।

Link copied!