‘আমার কাছে নাই গো বুবু ভাজা বাদাম’, এই গান গেয়েই জগত জোড়া খ্যাতি বীরভূমের দুবরাজপুরের ভুবন বাদ্যকরের। বাংলার গণ্ডি পার করে ‘কাঁচা বাদাম’ গান এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে। গ্রাম বাংলার সাধারণ বাদাম বিক্রেতাকে এখন সবাই চেনে এক ডাকে, ভুবন বাদ্যকর।
কথা বলতে ভালবাসেন তিনি। অনর্গল বলেও যেতে পারেন। ফলে আলাদা করে কোনও প্রশ্ন করার সুযোগই দেননি। আপন গতিতে নদীর মতো বয়ে চলেন ভুবন বাদ্যকর।
বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের কুড়ালজুরি গ্রামে কাঁচা বাদাম খ্যাত ভুবনের বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি মেজো। আর্থিক কারণে চতুর্থ শ্রেণির পর আর পড়াশোনা হয়নি। তা নিয়ে কোনও আক্ষেপও নেই অবশ্য তাঁর। বরং গান নিয়ে আরও আগে থেকে চর্চা করার সুযোগ পাননি বলে একটা আফসোস আছে।
দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাঁচা বাদাম বিক্রি করে আসছেন ভুবন। তারও আগে অবশ্য শাকসব্জি বিক্রি করতেন। বাদাম বিক্রি করে দৈনিক যে সামান্য রোজগার তিনি করতেন, তা দিয়েই কোনও মতে চলে যেত। কিন্তু সেই বাদামের হাত ধরেই বর্তমানে তাঁর এত নাম-ডাক, জনপ্রিয়তা, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য। স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে, বউমা, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার তাঁর। বড় ছেলে ইউটিউবার। কাঁচা মাটির বাড়ি এখন পরিণত হয়েছে লক্ষাধিক টাকার অট্টালিকায়। বেড়েছে ব্যস্ততাও। ফোন করা মাত্রই কথা বলা যাবে না তাঁর সঙ্গে। কারণ তিনি ব্যস্ত থাকেন নানা রকম ‘মিটিং’য়ে।
একাধিক বার চেষ্টা করার পর বিকেল ৪টে নাগাদ সময় পাওয়া গেল তাঁর। গলায় ভরপুর আন্তরিকতা। ফোনে সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে তাঁর গলায় উৎকণ্ঠার আভাস পাওয়া গেল খানিক। সাক্ষাৎকার নয়, আপনার সঙ্গে গল্প করব— এ কথা শুনে অবশ্য আশ্বাস পেলেন। শুরু হল আলাপচারিতা। সারা দিন কী ভাবে কাটে? জিজ্ঞেস করতেই ভুবন গড়গড় করে শুরু করলেন তাঁর রোজের দিনলিপি।
রাত থাকতেই বিছানা ছাড়েন তিনি। স্নান সেরে পুজোয় বসেন। পুজো শেষে মালা জপতে বসেন। মালা জপা শেষ হলে কিছু ক্ষণ সময় দেন গানের পিছনে। নতুন গান লেখেন। গুনগুন করে কিংবা গলা ছেড়েই গান গেয়ে ওঠেন। তার পর একটু বেলা বাড়লেই জলখাবার সারেন মুড়ি আলুভাজায়। জীবনে বদল এলেও খাদ্যাভ্যাসে কিন্তু কোনও পরিবর্তন আসেনি তাঁর।
আজীবন নিরামিষ খান। ভুবন সেই অর্থে খাদ্যরসিক নন। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই তাঁর কাছে যথেষ্ট। বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন বলে শিকড়কে কিন্তু ভোলেননি ভুবন। এখনও সময় পেলেই বাদাম আর সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এখন অবশ্য বাদাম বিক্রি করার জন্য অত হাঁকডাঁক করতে হয় না। তাঁকে দেখলেই ছেঁকে ধরে গ্রামের লোকজন। বাদাম কেনে। গান শোনে। ‘আমাদের ভুবন’ বলে গর্ব করে। বেলা বাড়লে ভুবন বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তিনি ফিরলে রান্না চাপে। ৫৩ বছরেও এখনও তিনি যথেষ্ট সুস্থ-সচল। তাই এখনও সব দায়িত্ব ছেলেদের হাতে তুলে দেননি। নিজেই সামলান সব কিছু।