বাংলাদেশে ক্রিকেট এক আবেগের নাম। আবার অনেকে বলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসার শক্তি রাখে। এমন অনেক কথাই বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে শোনা যায়। গ্রাম থেকে শহর সবখানেই এখন ক্রিকেটের জয়জয়কার। ক্রিকেট মানেই যেন উন্মাদনা। কিন্তু এই বঙ্গদেশে কারা আনলো ক্রিকেট খেলা? চলুন জেনে নেয়া যাক বঙ্গদেশে কীভাবে এলো ক্রিকেট।
ক্রিকেট ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল উপনিবেশগুলোতে। এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, সিভিলিয়ান ও সামরিক বিভাগ–সংশ্লিষ্ট মানুষদের। শুরুতে খেলাটি সীমাবদ্ধ ছিল কেবল অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। যে কারণে একে বলা হতো ‘গেম অব লর্ড’। তবে দিন দিন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে রাজশাহী শহরে ক্রিকেট খেলার প্রচলন হয়েছে তুলনামূলকভাবে আগে। খ্রিষ্টীয় আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত রাজশাহী শহরে ইংরেজ, ডাচ ও ফরাসি নাগরিকদের সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁরাই পদ্মাতীরবর্তী সাহেবগঞ্জ নামক স্থানে ১৮৮২ সালে ‘ভিক্টোরিয়া ক্লাব’ নামে একটি খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
প্রথম দিকে ক্লাবটি ছিল ইনডোর গেমসনির্ভর। এর দুই-তিন বছরের মধ্যে সাহেবগঞ্জের কাছাকাছি পদ্মাতীরবর্তী পাঁচআনি খেলার মাঠে তাঁরা হকি ও ফুটবল খেলার প্রচলন করেন। এই মাঠে ১৮৯০ সালে ইংরেজরা প্রথম ক্রিকেট খেলা প্রদর্শন করে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
তখনকার রাজশাহী, তথা বৃহত্তর বঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জমিদার রানি ভবানীর পরবর্তী বংশধর মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের সাথে বিখ্যাত রায় পরিবারের সদস্য সারদারঞ্জন রায়ের (১৮৫৮–১৯২৫) অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আর সারদারঞ্জন রায়ই ছিলেন বাংলার ক্রিকেটের জনক। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি যুবসমাজে মূলত তাঁর আগ্রহ ও প্রচেষ্টাতেই ক্রিকেট খেলার প্রচলন ঘটে। সারদারঞ্জন নিজেও ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেটার। কলকাতা শহরে নিজস্ব খেলার সরঞ্জাম ও পুস্তকের দোকান ছিল তাঁর।
১৯০১ সালে জগদিন্দ্রনাথ রায়ের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কলকাতার বালিগঞ্জের নাটোর পার্কে প্রতিষ্ঠা পেল ‘নাটোর ইলেভেন’ নামে বাঙালিদের একটি ক্রিকেট দল। দলটি ‘নাটোর টিম’ নামেও পরিচিতি পেয়েছিল। জগদিন্দ্রনাথের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বাংলার ক্রিকেটকে উন্নত মানে নিয়ে যাওয়া। এ জন্য ১৯০১ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি ক্রিকেট মৌসুমে কলকাতা শহরের ব্রিটিশ সাহেবদের বিভিন্ন ক্রিকেট দলের সঙ্গে নিয়মিত ম্যাচ খেলার আয়োজন করতেন তিনি।
বিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের জামনগরে একটি বিখ্যাত ক্রিকেট দল ছিল। এই টিমের দলনেতা ছিলেন তখনকার ‘ক্রিকেট সম্রাট’—যাঁর নামে হয়েছে রঞ্জি ট্রফির নামকরণ—সেই রঞ্জিত সিং। একবার তিনিও তাঁর দল নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়; নাটোর ইলেভেনের সঙ্গে ম্যাচ খেলতে।
বাংলার ক্রিকেটের কীর্তিমান পুরুষ নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ। সারদারঞ্জন রায় ছিলেন বঙ্গ–ক্রিকেটের জনক আর জগদিন্দ্রনাথ রায় ছিলেন অবিভক্ত ভারতের প্রথম বাঙালি ক্রিকেট সংগঠক। বিশ শতকের শুরুতে এই দুই স্বপ্নদ্রষ্টার আন্তরিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল বাঙালির ক্রিকেট দল—নাটোর ইলেভেন। আজ সাকিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্ব ক্রিকেটে অঙ্গনে সুনাম কুড়াচ্ছে এক বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকারী হয়েই।