জহির রায়হান: জীবনের জয়গান গাওয়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ৩০, ২০২৩, ০৩:১৪ পিএম

জহির রায়হান: জীবনের জয়গান গাওয়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক অনেক পরিচয় তাঁর। তিনি ছিলেন একাত্তরে নিহত বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক শহিদুল্লাহ কায়সারের অনুজ।

মাত্র ৩৬ বছর বয়সের জীবনেই জহির রায়হান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী একজন কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র-পরিচালক হিসেবে। প্রচণ্ড বক্তব্যধর্মী ও জীবনমুখী তার চলচ্চিত্রগুলো নান্দনিকতা ও কৌশলগত মানের দিক থেকে এখনো স্মরণীয় হয়ে টিকে আছে।

দেশের খ্যাতিমান এই ঔপন্যাসিকের নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ খান। তবে তিনি জহির রায়হান নামেই বেশি পরিচিত।

এই মহান বাঙ্গালী  ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু’বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাভেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথে তেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন।

১৯৭০ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া'। এটি জহির রায়হানের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বলে বিবেচিত। সামাজিক এই চলচ্চিত্রে তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল। এতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে আমার সোনার বাংলা গানটি প্রথম চিত্রায়িত হয়েছিল। এখন যা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। একই বছর 'টাকা আনা পাই' নামে আরও একটি অসামান্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সেই বছরই তিনি নির্মাণ শুরু করেছিলেন তার লেট দেয়ার বই লাইট চলচ্চিত্রের। এই চলচ্চিত্রটি ছিল চিত্রনাট্য ছাড়া। এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্য থেকে সংলাপ সবই ছিলো জহির রায়হানের উপস্থিত মেধায় রচিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান চলে যান ভারতের কলকাতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। শুরু করেন তার বিখ্যাত স্টপ জেনোসাইড তথ্যচিত্র তৈরির কাজ। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে তার নির্মিত 'স্টপ জেনোসাইড'কে। যার প্রতিটি সেকেন্ডে মিশে আছে একটি জাতির চিহ্ন। একটি জাতির অসীম ত্যাগের ইতিহাস।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার ক্ষেত্রে 'স্টপ জেনোসাইড' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধে জহির রায়হানের প্রভাব এতো বিস্তৃত যে হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও শেষ হবে না। স্টপ জেনোসাইড থেকে শরণার্থী ক্যাম্প, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে মিটিং, সভা সমাবেশে জনমত গঠন করেছিলেন।

জহির রায়হান ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন। মিরপুরে তার ভাই শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও অনেককে বিহারিরা আটকে রেখেছে বলে খবর পেয়ে ৩০ জানুয়ারি সকালে তিনি সেনাবাহিনী ও পুলিশের বহরের সঙ্গে মিরপুর ১২ নম্বরের দিকে যান। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিহারিরা কালাপানি পানির ট্যাংকের সামনে সেনা ও পুলিশ সদস্যদের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে তিনি নিহত হন। পরদিন ৩১ জানুয়ারি মিরপুর বিহারি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলমুক্ত হলেও তার লাশ পাওয়া যায় নি।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের দুই স্ত্রী’র একজন সুমিতা দেবী। এই প্রয়াত অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্মাতা। আরেক স্ত্রী সুচন্দার ছোট ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা। তিনি ‘সবুজ কোট কালো চশমা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। জহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার।

Link copied!