৮ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা। ৩৬ বছরের সোনালি ট্রফিটার আক্ষেপ কিংবা মেসির শেষ বিশ্বকাপ রাঙানো- ফরাসিদের বিপক্ষে জানপ্রাণ উজাড় করে দিতে প্রস্তুত আলবিসেলেস্তেরা। রোববার (১৮ ডিসেম্বর) শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে লিওনেল মেসির দল। আর্জেন্টিনার এবার বিশ্বকাপ জয় নিয়ে অনেকের মতো আশাবাদী বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা।
বিশ্ব ফুটবলে বরাবরই আর্জেন্টিনার সমর্থক সাবেক অধিনায়ক মাশরাফী। ম্যারাডোনার ফুটবলশৈলীর প্রেমে পড়ে আর্জেন্টিনাকে ভালোবেসেছেন ম্যাশ। প্রিয় দলকে বিশ্বকাপ জিততেই হবে, এমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না কখনো। তবে এবার যেন সেই আশার দেখতে পাচ্ছেন তিনি।
আর্জেন্টিনার ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর মাশরাফি প্রায় ৫০০ শব্দের দীর্ঘ এক লেখা লিখলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জানালেন আর্জেন্টিনা দলের বিশ্বকাপ যাত্রা নিয়ে ভাবনা, ফাইনালে দলের কাছে চাওয়া।
আট বছর আগে ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল আর্জেন্টিনার। সে স্মৃতি স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, ‘আট বছরে দুই বার। আট বছর আগে রোজা চলছিল, সেহেরীর ঠিক পরেই গোৎজের গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েছিল আর্জেন্টিনা। তখন মনে হয়েছিল আর সম্ভব না, কারণ বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠা চারটেখানি বিষয় না। সেখানে শুধু ভালো খেললেই হয় না, অনেক সমীকরণ সঙ্গে ভাগ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮'তে রাউন্ড অফ সিক্সটিনেই বাদ, সাত গোলের খেলায় তিনটা দিয়েও টিকে থাকতে পারল না।
এবার সবাই যখন বলছিল টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত, আসলে মন সাড়া দেয়নি কারণ, বিশ্বকাপ অন্য জিনিস। এখানে ফাইনালে যেতে রাউন্ড সিক্সটিন থেকে ফাইনালে পৌঁছানোর ধাপই তিনটি, যেখানে নকআউট পদ্ধতির আগেতো গ্রুপ রাউন্ড আছেই। আশঙ্কা সত্য হয়ে প্রথম ম্যাচই সৌদির কাছে হার, পরে সব ম্যাচই অলমোস্ট ফাইনাল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলছে, এটা ভাবাই যায় না।
আর্জেন্টিনা রোড টু ফাইনালের সব ম্যাচই দেখেছি, প্রথমবারের মতো মেসিকে যেভাবে বিশ্বকাপে দেখতে চেয়েছি সেটা দেখে আরও ভালো লেগেছে। এখনও পর্যন্ত তিনটা অ্যাসিস্টসহ পাঁচটা গোল। এমবাপ্পের সঙ্গে একই অবস্থানে। যদি দুজনের কেউ ফাইনালে গোল না করে, অ্যাসিস্ট এর কারণে গোল্ডেন বুট মেসিই পাবে। আর পেনাল্টি নিয়ে যতো কথা, আমার তো মনে হয় মেসির পেনাল্টি মিস নিয়েই এ যাবৎকাল সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে। নিন্দুক হতে তো জ্ঞানী হতে হয় না, হতে হয় কট্টরপন্থী।
মেসি ছাড়াও আর্জেন্টিনার বাকি সদস্যরা দারুণ পারফর্ম করছেন। সে কারণেই মাশরাফী দলকে নিয়ে আশা দেখছেন। বলেন, ‘আর্জেন্টিনার এই দলটার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, দলের সবাই জানে মেসি সেরা কিন্তু মেসির সেরাটার জন্য কেউ বসে থাকছে না। হিগুয়েন, অ্যাগুয়েরো ঘুরে শেষ মেষ একজন স্ট্রাইকার (আলভারেজ) পেলো যে আসলে দরকারের সময় গোল করেছে। দি পল তো মেসির না শুধু, পুরো দলেরই ভ্যানগার্ড। প্রথম ম্যাচ বাদে রোমেরো, ওতামেন্দি ঠিকঠাক নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। আর ২১ বছর বয়সী (এঞ্জো) ফার্নান্দেজ তো এবার বিশ্বকাপের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের অন্যতম দাবিদার। গোলবারে (এমিলিয়ানো) মার্তিনেজ দারুণ। আর সবাইও খুব খারাপ করেনি।
আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্ক্যালোনিকে নিয়েও নিজের মুগ্ধতার কথা জানালেন মাশরাফী। বলেন, এতো কিছুর পর একজনের কথা না বললেই না, সে হলো লিওনেল স্কালোনি। বয়স কম কিন্তু দারুণ একজন সাহসী মানুষ। প্রথম ম্যাচের পর মূল দলের বাহিরে গিয়ে এভাবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এতো বড় টুর্নামেন্টে কিছু তরুণদের উপর আস্থা রাখা, এবং তাদের থেকে সেরাটা বের করে আনা এক কথায় অসাধারণ। ভিন্ন ভিন্ন ম্যাচে ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাট, যা শুরুতে মনে হয়েছে এতো চেঞ্জ করছে কেন, পরে আসলেই আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা দারুণ ভাবে সেটার সঙ্গে মানিয়ে পারফর্ম করে ম্যাচ জিতিয়ে এনে স্কালোনিকে আরও সাহসী করে তুলছে। শুধু দুইটা ম্যাচের উদাহরণ দেই নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে নামলো পাঁচ ডিফেন্স নিয়ে হাফ টাইমে করে ফেললো চার, ঠিক পরের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে নামলো চার ডিফেন্স নিয়ে হাফ টাইমে করল পাঁচ। এই যে খেলার ভেতরেই ফরমেশন চেঞ্জ করা তাও হাফ টাইমে, অপনেন্টকে রিয়াকশনের সময় না দেয়া, দারুণ কিছু মুভ তার থেকে দেখা গেছে। ইনফ্যাক্ট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও ৫০ মিনিটে হুট করেই চার ডিফেন্স থেকে পাঁচটা করে দেয়া এবং তারজন্য খেলোয়াড়দের মানসিক প্রস্তুত করা, সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে, নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করে এতো প্রো-এ্যাকটিভ থাকা আসলেই অসাধারণ।
সবশেষে বলেন, একটা ম্যাচ বাকি, সব ঠিকঠাক ভাবে মিললে হয়তো কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাবে, আর না হলে আরও একবার ফাইনালে হেরে রানার্সআপ। তবে তাতে আর্জেন্টিনার এই বীরত্বে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়বে না। ফ্রান্স অলরেডি দেখিয়েছে তারা কেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। একজন আর্জেন্টিনা দলের চরম ভক্ত হিসেবে চাই এ বিশ্বকাপ জিতুক, সবার চাওয়া হয়তো মেসির জন্য, আমারও খুব ভিন্ন না, তবে তার আগে জিততে চাই শুধুই আর্জেন্টিনার জন্য, যে দলকে ভালোবেসেছি স্রেফ আর স্রেফ একজনকে দেখে দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা। গুরু ওপারে ভালো থেকো, অফুরন্ত ভালোবাসা তোমায় জন্য।'