ফিকো যেভাবে হয়ে উঠলেন বলিউডের অর্ফেউস

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২৪, ২০২২, ০৭:৪৩ এএম

ফিকো যেভাবে হয়ে উঠলেন বলিউডের অর্ফেউস

বলিউডের অর্ফেউস বলা হয় তাকে। অর্ফেউস ছিলেন গ্রিক পুরাণের সেরা গায়ক এবং দেবতা অ্যাপোলোর বরপুত্র। বীণা বাজিয়ে অর্ফেউস যখন গান গাইতেন তখন সাগর, নদী, পাহাড়, পর্বত, দেব-দানব সবাই তন্ময় হয়ে শুনতেন তাঁর গান। দেবরাজ জিউসও তার গানে মুগ্ধ হতেন। বলা হয়ে থাকে অর্ফেউস যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করতেন তাহলে তিনি বলিউডের এক প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী হয়েই জন্মগ্রহণ করতেন। আর ওই প্রখ্যাত শিল্পীর নাম মোহাম্মদ রফি।

ভারতীয়  উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মোহাম্মদ রফি ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন বিনয়ী ও সাদাসিধে মানুষ। গান গেয়ে অনেক জায়গায় পারিশ্রমিক নেননি। ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারণে অনেক সিনেমায় বিনা পারিশ্রমিকে গান করেছেন।

জন্ম ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অভিষেক

১৯২৪ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণকারী সংগীত জগতের এই ধ্রবতারা ও বলিউডের এই অর্ফিউস তার অসংখ্য কালজয়ী গানের মধ্যে অমর হয়ে আছেন।

ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের কাছে কোটলা সুলতান সিংয়ে জন্সগ্রহণ করেন মোহাম্মদ রফি। ডাক নাম ফিকো। মোহাম্মদ রফি মাত্র ১৩ বছর বয়সে লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে এল সাইগলের সাথে প্রথমবারের মতো কনসার্টে সংগীত পরিবেশন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

১৯৪১ সালে  লাহোরে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে অভিষেক ঘটান। পাঞ্জাবী ভাষায় নির্মিত গুল বালুচ (১৯৪৪ সালে মুক্তি পায়) চলচ্চিত্রে জিনাত বেগমের সঙ্গে  দ্বৈত সঙ্গীত "সোনিয়ে নি, হেরিয়ে নি" গানটি গান। একই বছরে মোহাম্মদ রফি অল ইন্ডিয়া রেডিও'র লাহোর সম্প্রচার কেন্দ্রে গান পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ পান।

সঙ্গীতে পেশাগতভাবে অভিষেক

১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের পরিচালনায় ‘গুল বালোচ’ ছবির মাধ্যমে সঙ্গীতে পেশাগতভাবে অভিষেক ঘটান রফি। পরের বছর বোম্বের চলচ্চিত্র ‘গাও কি গৌরী’  ছবিতে নৈপথ্য গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটান। এছাড়াও রফি ‘লায়লা-মজনু (১৯৪৫) এবং ‘জুগনু ‘ চলচ্চিত্রে সংক্ষিপ্তভাবে, অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। লায়লা-মজনু চলচ্চিত্রে 'তেরা জ্বালা'  কোরাস গানে  তাকে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে গাইতে দেখা যায়।

মোহাম্মদ রফি তার সুদীর্ঘ সংগীত জীবনে অনেক নামকরা সঙ্গীত পরিচালকের দিক-নির্দেশনায় বিভিন্ন ধরনের গান গেয়েছেন। তার মধ্যে অমর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নওশাদের পরিচালনায়ই গান গেয়েছেন বেশি।

এছাড়াও, ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে ওপি নয়ার, শঙ্কর জয়কিশান, এসডি বর্মন, গীতিকার মদন মোহনসহ প্রখ্যাত সুরকার ও গীতিকারের সঙ্গে কাজ করেছেন।

লতা মঙ্গেশকর-মোহাম্মদ রফি জুটি

লতা মঙ্গেশকরের সাথে মোহাম্মদ রফির জুটিকে বলিউড ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জুটি ধরা হয়। তারা ১৯৪৯ সালে ‘বারসাত’ ছবি থেকে শুরু করে একনাগাড়ে রফির মৃত্যু পর্যন্ত ৫০০ এর অধিক দ্বৈত গানে অংশ নেন।

এক সাক্ষাৎকারে লতা মুঙ্গেশকর মোহাম্মদ রফি সম্পর্কে বলেন, ‘একশো বছরেও মোহাম্মদ রফির মতো কণ্ঠ আর আসবে না৷’

মোহাম্মদ রফি-আশা ভোঁসলে জুটি

অন্যদিকে, আশা ভোঁসলের সাথে রফির জুটিকে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জুটি বলা হয়। তারা ১৯৫০-৮৭ সাল পর্যন্ত সঙ্গীতে যুক্ত ছিলেন (১৯৮০ সালে তার মৃত্যুর পর এক দশক পর্যন্ত রফির গান মুক্তি পেতে থাকে)। আশা ভোঁসলে আর মোহাম্মদ রফি মোট ৯১৮টি দ্বৈত গানে কণ্ঠ দিয়েছেন, যা বলিউডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

গিনেস বুক ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস নিয়ে লতার সাথে বিবাদ

সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড সংক্রান্ত গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে  প্রখ্যাত সিংগীশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের নাম উঠলে তিনি এর প্রতিবাদ জানিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেন।

১৯৭৭ সালের ১১ জুন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষকে লিখিত একটি চিঠিতে তিনি জানান, লতাজী সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করেছেন সত্য; কিন্তু তা গিনেস কর্তৃপক্ষের ভাষ্য মোতাবেক ২৫,০০০ গানের কম নয়। একই বছর ১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ রফি দাবি করেন, তিনি ওই সময় পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৬ হাজারের মতো গান গেয়েছেন।

গিনেস থেকে পত্র প্রাপ্তির প্রত্যুত্তরে রফি ২০ নভেম্বর, ১৯৭৯ সালে চিঠিতে লিখেন: আমি খুবই মর্মাহত যে আমার অনুরোধ পুনর্বিবেচনা করা হয়নি। এমনকি আমার নাম অন্তর্ভুক্তির বিপরীতে মিস মঙ্গেশকরের দাবিকৃত বিশ্বরেকর্ডটি অপসারণও করা হয়নি। অবশ্য পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে মোহাম্মদ রফি এবং লতা মঙ্গেশকর উভয় কণ্ঠশিল্পীর নামই গিনেস বুক থেকে অপসারণ করা হয়।

সঙ্গীতে রাজকীয় ক্যারিয়ার

প্রায় চল্লিশ বছর সময়কাল ধরে সঙ্গীত জগতে থাকাকালীন চলচ্চিত্রের ২৬ হাজারেরও অধিক গানে নেপথ্য গায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন মোহাম্মদ রফি। তনি বহুবিধ গানে অংশ নেয়ার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বিরহ-বিচ্ছেদ, উচ্চ মার্গের প্রেম-ভালবাসা, কাওয়ালী, ভজন, গজল-সহ বিভিন্ন গোত্রের গানে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন সমানভাবে। বিশেষ করে হিন্দি ও উর্দু  ভাষায় সমান দক্ষতা থাকায় তার গানগুলোতে বৈচিত্র্য এসেছে সমধিক।

অন্যের কণ্ঠস্বর নকল করে গান গাওয়ার মতো একটি দুর্লভ বৈশিষ্ট্য ছিল মোহাম্মদ রফির। এর ফলে তিনি যে অভিনেতার জন্য প্লেব্যাক করতেন তার মতো কণ্ঠস্বরে গানটি গাইতে পারতেন। আর একারণেই প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে দিলিপ কুমার, দেবানন্দ, রাজকাপুরসহ  সেরা সব নায়কদের জন্য গান করে তুমুল জনপ্রিয়তা পান তিনি।

যেসব ভাষায় গান গাইতেন

হিন্দিসহ উর্দু, ভোজপুরী, উড়িয়া, পাঞ্জাবী, বাংলা, মারাঠী, সিন্ধী, কানাড়া, গুজরাতি, তেলেগু, মাঘী, মৈথিলী, অহমীয়া ইত্যাদি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন। এছাড়াও আরও গান গেয়েছেন - ইংরেজি, ফার্সী, স্প্যানিশ এবং ডাচ ভাষায়।

সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পদক এবং ৬-বার ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারে ভূষিত এছাড়াও, ১৯৬৭ সালে ভারত সরকার পদ্মশ্রী সম্মানেও তাকে ভূষিত করে।

 

Link copied!