বেগম রোকেয়ার আলোকবর্তিকা নারী সমাজকে পথ দেখিয়েছে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ৯, ২০২২, ১১:৫৪ পিএম

বেগম রোকেয়ার আলোকবর্তিকা নারী সমাজকে পথ দেখিয়েছে

এই উপমহাদেশের নারীমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টাদের অন্যতম বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) একজন সমাজসংস্কারক, নারীশিক্ষা প্রচারক এবং সাহিত্যিক রূপে বাংলাদেশের নবজাগরণের সূত্রপাতের অগ্রদূত হিসেবে জাতীয় ভিত্তিতে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি পেয়েছেন।

উন্নত বিশ্বের নারীমুক্তি ও নারীজাগরণের উত্তাল ঢেউয়ের আলোড়ন আমাদের নারীসমাজের কাছে পৌঁছাবার বহু পূর্বেই বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্মে তাঁর যুক্তিনির্ভর ও সাহসী বক্তব্য, ব্যক্তিগত জীবনের কর্মকাণ্ড এ দেশের নারীসমাজকে নারীর অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে এবং এই প্রাপ্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা দেয়। এ দেশের নারীসমাজ তাঁরই আলোকবর্তিকার দ্বারা ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে আলোকিত জীবনের দিকে অগ্রযাত্রা শুরু করতে সক্ষম হয়েছে, এ কথা বিনা দ্বিধায় আজ আমরা বলতে পারি।

বাংলার নারীজাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা সাবের চৌধুরী।

রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও রোকেয়া নারীজাগরণের জন্য কাজ করে গেছেন, যে সময় নারীর শিক্ষাগ্রহণ তো দূরের কথা, ঘর থেকে বাইরে বের হওয়াই ছিল কঠিন কাজ। তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থার কারণে রোকেয়া ও তার বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি। তাদের ঘরে আরবি ও উর্দু শেখানো হয়। বাংলা শেখা ছিল নিষিদ্ধ! তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিক মনস্ক ছিলেন।

১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী ও বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রোকেয়া। স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন মুক্তমনে চিন্তা করার সাহস ও সহযোগিতা। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান।

স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে তিনি ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু পারিবারিক কারণে রোকেয়া ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে তিনি নবপর্যায়ে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।

বেগম রোকেয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৭ সালে এই স্কুল মধ্য ইংরেজি গার্লস স্কুলে এবং ১৯৩১ সালে উচ্চ ইংরেজি গার্লস স্কুলে রূপান্তরিত হয়। ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও প্রাতিষ্ঠানিক কারণসহ অন্যান্য কারণে স্কুলটি বহুবার স্থান বদল করে।

শৈশব থেকে মুসলমান নারীদের যে দুর্দশা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাই ছিল এই স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য। তাঁর স্কুলে মেয়েদের পাঠাবার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি অভিভাবকদের অনুরোধ করতেন। যে যুগে কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে বাঙালি মুসলমানরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করত, সেই অন্ধকার যুগে বেগম রোকেয়া পর্দার অন্তরালে থেকেই নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রয়াসী হন এবং মুসলমান মেয়েদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের পথ সুগম করেন।

স্বশিক্ষিত রোকেয়া সাখাওয়াত ব্যক্তিজীবনে ছিলেন স্বনির্ভর, মহৎ, সর্বগুণান্বিতা, দরদি, কোমল মনের অধিকারী; অথচ প্রয়োজনে প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব রূপে প্রতিভাত হয়েছেন। নারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান রূপে তিনি সর্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছেন মানবাধিকারের বাঙালি মুসলিম প্রবক্তা হিসাবে। মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি যে আলোর মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছেন, তা পথনির্দেশক হয়ে রইবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের নারীসমাজের জন্য।

Link copied!