ইউক্রেনে রুশ হামলার ১ মাস পূর্তি হলো আজ। গত ২৪ ফেব্রুয়ারী ইউক্রেনের হামলা শুরু করে রুশ বাহিনী। শুরুর দিনই চেরনোবিলের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখলে নেয় রুশ সৈন্যরা। এরপর অন্যান্য শহরের উপর শুরু হয় রুশ বাহিনীর স্থল ও বিমান হামলা। সম্প্রতি সমুদ্র থেকেও হামলা শুরু হয়েছে। এক মাস পূর্তির দিনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দেশব্যাপী বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন।
ভাবা হচ্ছিলো কয়েকদিনের মধ্যেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে পরাজিত করতে পারবেন। তবে এক মাসের ব্যবধানে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবেই ধরা দিয়েছে। হামলা চালানোর পর ইউক্রেনের সৈন্যরা অত্যন্ত ধৈর্যসহকারেই রুশ হামলাকে প্রতিহত করে চলেছেন। এখন পর্যন্ত রাজধানী কিয়েভের দখল নিতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর একটি রাশিয়া।
আয়তনে সবচেয়ে বড় এ দেশেই সবচেয়ে বেশি পারমানবিক অস্ত্রেরও মজুদ রয়েছে। রাশিয়ার পারমানবিক ওয়ারহিড, যে যন্ত্রটি পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, রয়েছে ৫ হাজার ৯শ ৭৭টি। এরমধ্যে দেড় হাজারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে সক্রিয় ওয়ারহিডের সংখ্যা ৪,৪৭৭টি। এরপরে ৫,৪২৮টি ওয়ারহিড নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র।
এক মাস ধরা চলমান থাকা এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের ১ কোটিরও বেশি বাসিন্দা তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউবা কোন সড়কের পাশে, কেউ পরিত্যক্ত কোন ভবনে আবার কেউ কোন শপিং মল, মসজিদ, হাসপাতাল বা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও এসব স্থাপনা লক্ষ্য করেও রুশ হামলা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের মারিউপুল শহরের একটি মসজিদে, যেখানে শিশুসহ ৮০ জনের মত নাগরিক আশ্রয় নিয়েছিলো, মিসাইল হামলা চালায় পুতিনের বাহিনী।
একটি নাট্যশালাতেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। যেখানে কমপক্ষে ১২শর মত বেসামরিক নাগরিক আশ্রয় নিয়েছিলো। জাতিসংঘ বলছে, এখন পর্যন্ত রুশ হামলায় ৯শর মত ইউক্রেনিয়ান বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। আর ইউক্রেন দাবি করছে, তাদের পাল্টা হামলায় ১০ হাজারের বেশি রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে। যদিও রাশিয়া বলছে, ৫শর কিছু বেশি রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর উপর রুশ কড়াকড়ি থাকায়, হতাহতের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের হিসাবে, এখন পর্যন্ত ৩৫ লাখেরও বেশি নাগরিক ইউক্রেন ছেড়ে পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। এরমধ্যে শুধুমাত্র পোল্যান্ডেই গিয়েছেন ২০ লাখেরও বেশি নাগরিক। এছাড়া হাঙ্গেরি, আর্মেনিয়াসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকরা আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও আশ্রয় দেওয়া দেশগুলো তাদের থাকা-খাওয়ার ভালই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত চেরনোবিলের ওই পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, খেরসান শহরসহ কয়েকটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে সমর্থ হয়েছে রুশরা। কিয়েভ, মারিউপুল,সুমি,খারকিভসহ কয়েকটি এলাকায় রুশ বাহিনীকে খুব ভালোভাবেই মোকাবেলা করছে ইউক্রেনের সৈন্যরা। এমনকি রুশ বাহিনীর কাছ থেকে দখল হয়ে যাওয়া কিছু শহরের পুননিয়ন্ত্রণ নিতে সফলতা দেখাচ্ছে ইউক্রেনের সৈন্যরা। ওদিকে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এখনো কিয়েভে পৌছাতে পারেনি রুশ বাহিনীর দীর্ঘ ৪০ মাইল সৈন্য বহর। রসদ ও তেলের সংকটও দেখা দিয়েছে ওই বহরে।
এমন অবস্থায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অর্থনৈতিকসহ পশ্চিমাদের নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত আছে। নতুন করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কি ধরণের অবরোধ আরোপ করা যায়, সে বিষয়ে মিত্রদের সাথে আলোচনা করতে আজ বুধবার ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ সফরে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমিয়ে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তার পাশাপাশি অর্থ সহায়তাও অব্যাহত রেখেছে পশ্চিমারা।
যদিও পুতিন এসবের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। এজন্য প্রতিবেশী বেলারুশের মিনস্কে ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধের জন্য কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও কার্যত কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের উদ্যোগও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাশিয়ার ভেটোতে ভেস্তে গেছে।
(রাশিয়া-ইউক্রেন প্রতিনিধিদের বৈঠকের ছবি)
পুতিন যুদ্ধ বন্ধে কয়েকটি শর্ত দিয়েছেন। এরমধ্যে যুদ্ধ শুরুর আগের সেই শর্তটিও রয়েছে। মূলত ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে জোরালো উদ্যোগ নেওয়ার পরই দেশটির সীমান্তের কাছে ১ লাখ ৯০ হাজার রুশ সৈন্য জড়ো করেন পুতিন। যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হতে চাওয়ার ইচ্ছা একেবারেই বাদ দিতে হবে বলে জানিয়েছেন পুতিন। তিনি মনে করেন, মার্কিন আধিপত্য থাকা ৩০টি দেশের সামরিক জোট ন্যাটোকে নিয়ে ইউক্রেন ক্রিমিয়ার দখল ফিরে পেতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে পারে।
ইউক্রেনের অংশ থাকা ক্রিমিয়াকে ২০১৪ সালে দেশটি থেকে আলাদা করে নিজেদের দখলে নেন পুতিন। এরপর থেকেই সেখানে রুশ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এছাড়া ইউক্রেনের অন্যান্য দুটি শহর- দোনেৎস্ক ও লুহানৎস্কে রুশপন্থীরা রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চান। পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনের রুশপন্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে হবে ইউক্রেনকে। তবেই যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে।