২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। শনিবার। রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক বিকেল। সময় তখন ঘড়ির কাটায় ৫টা ছুঁই ছুঁই করছে। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সেখানেই খোলা ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে এক সমাবেশে বক্তৃতা সবেমাত্র শেষ করলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা সমাবেশে মুহূর্তে নেমে এলো গ্রেনেডের বিভীষিকা। কারো বা হাত, কারো বা পা, কারো বা মাথার মগজ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল গিয়ে পিচঢালা পথে। মূহুর্তেই রক্তে রঞ্জিত গোটা সমাবেশ স্থল। চারদিকে আর্তনাদ। প্রাণ হারালেন আওয়ামী লীগের ২৪জন নেতাকর্মী। আহত হলেন কয়েকশ। হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন শেখ হাসিনা।
যে কোন সুস্থ মানুষ, সুস্থ রাজনৈতিক ধারা চর্চাকারী এই দিনটিকে গণতন্ত্রের কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বারবার হামলা হয়েছে, জীবনের উপর ঝুঁকি নেমেছে, তবে তা থামিয়ে রাখতে পারেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে চালানো সেই হামলা আজও গণতন্ত্রকামী এদেশের মানুষের মনে দহনের সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশের উপর এরকম হামলা এর আগে কখনো হয়নি। ভয়াল সেই হামলার সপ্তদশ বার্ষিকী ছিল শনিবার। দিনটির স্মরণে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সবিস্তারে বলেছেন সেই হামলার পটভূমি, কারা সেই হামলা চালিয়েছিল, কী ছিল হামলাকারীদের উদ্দেশ্য, নেপথ্যে ছিল কারা, সেসব কথা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছেন, পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্টের পর তার উপর ধারাবাহিক হামলার যে ঘটনা, তারই ধারাবাহিকতায় হয় ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা, আর এই চক্রান্তের মূল ভূমিকায় ছিলেন তারেক রহমান, তাতে সমর্থন ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ারও।
‘ফিরে দেখা: ভয়াল ২১শে অগাস্ট’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে শনিবার প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলাম।
পাঠকদের জন্য সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হল।
প্রশ্ন: ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্ট আপনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে এক ডজনেরও বেশি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এই হামলায় আপনি প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ দলের ২২ নেতা-কর্মী সেদিন নিহত হন, আহত হন প্রায় ৫শ’ মানুষ। পেছনে ফিরে তাকালে এ সম্পর্কে আপনার কী অনুভূতি হয়?
শেখ হাসিনা: দেখুন বিএনপি সরকারের আমলে সারা বাংলাদেশে একটা সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য সৃষ্টি হয়েছিল, একটা রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। তখন বাংলাভাই সৃষ্টি, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, বোমা হামলা এটা যেন প্রতিনিয়ত চলছিল। নানা ঘটনা তো এই বিএনপির ২০০১ সালের সেই অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ২০০৪ সালে ২১শে অগাস্ট যখন সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মাজারে গ্রেনেড হামলা করা হয় এবং সেখানে বেশ তিন/চারজন লোক মারাও যায় আর ব্রিটিশ হাইকমিশনার সেই গ্রেনেডে আহত হয়। একজন কূটনৈতিককে হামলা করা এবং তাকে আহত করা যেটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিদেশে খুব খারাপভাবে নষ্ট করে। তো আমরা এই সন্ত্রাসবিরোধী একটি র্যালি করার সিদ্ধান্ত নেই এবং সেই র্যালি যখন আমরা করছিলাম, আমরা প্রথমে অনুমতি চেয়েছিলাম কিন্তু বিএনপি সরকার অনুমতি দেয় নাই। আমরা মুক্তাঙ্গনে করতে চেয়েছিলাম, ওরা দেয়নি, তখন আমরা প্রস্তুতি নেই যে ঠিক আছে আমরা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনেই করব। তার আগের দিন রাত্রি বেলা ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ তারা আবার পারমিশন দেয়। কিন্তু তখন আমাদের মাইক লাগানো হয়ে গেছে, পোস্টার ছাপানো, প্রচার সব কিছু তৈরি হয়ে গেছে। তা আমরা ওখানেই আমাদের সমাবেশটা করি।
কিন্তু ওই সমাবেশে যখন আমি যাই, বক্তব্য রাখি এবং বক্তব্য রেখে আমি মাইকটাও হাত থেকে রাখতে পারিনি, এরই মধ্যে বোমার আওয়াজ। বোমার আওয়াজটা হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে আমাদের নেতা-কর্মীরা ধরে বসিয়ে দেয়। বিশেষ করে হানিফ ভাইয়ের (সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) কথা আমি বলব। সে ছিল। তাছাড়া মামুন ছিল আমার সাথে, নজীব-সে ছুটে আসে, মায়া-ওরা সবাই ওখানে ছিল। তাদের সবাই তখন ট্রাকের ভেতরেই ছিল ওরা। ট্রাকের ভেতরেই সবাই আমাকে একদম ঘিরে রাখে এবং একটার পর একটা গ্রেনেড কিন্তু..। প্রথমে ৩টা তারপরে আবার ৩টা, এভাবে করতে করতে প্রায় এক ডজনের কাছাকাছি গ্রেনেড তারা ছুড়ে মারে। সত্যি কথা বলতে কি তখন আসলে নিজের কথা ভাবার থেকেও আমার চিন্তা ছিল আমার এতগুলো মানুষ আমরা ট্রাকের উপরে। আর আশে পাশে আমাদের নেতা-কর্মীরা সবাই।
আর সেই সময় কার যে কী অবস্থা কিছুই বুঝতে পারছি না। তো যাই হোক, যখন একটা পর্যায়ে যখন গ্রেনেড হামলা মানে একটু থামল। থামার পরে আমাকে যে গ্রেনেড মেরেছিল সেটার যে স্প্রিন্টারগুলো সব যেহেতু হানিফ ভাই, তখন ঢাকার সিটি মেয়র সে আমাকে যখন এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল, সমস্ত স্প্লিন্টারগুলো তার মাথায় পড়ে, তার গায়ে পড়ে। এবং তার ওই রক্ত আমার শরীরে, আমার কাপড়ে চলে আসে। সবাই ভাবছে, আমি বোধ হয় আহত। তাই আমাকে ধরে উঠাচ্ছে। আমি বললাম, আমার তো কিছু হয়নি। কেন যেন এটা আমার কাছে একটা বিস্ময় যে আমার গায়ে কোনো একটা স্প্লিন্টারও লাগেনি। কিন্তু আমার চশমাটা হারিয়ে যায়।
তারপরে আমি ওখান থেকে আবার গাড়িতে— যেই মুহূর্তে গাড়িতে উঠতে যাব, গাড়ির দরজাটা খুলে দেওয়া হয়েছিল। আমার সাথে একজন সেনা কর্মকর্তা (অবসরপ্রাপ্ত) মাহবুব, ও ছিল আমার ড্রাইভার কাম সিকিউরিটি। ওরা গেটটা খুলে দাঁড়ায়, আর ঠিক সে সময়ে সেখানে গুলি একটা চলে আসে এবং মাহবুব গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই মারা যায়। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে সে সময় চলে আসি, সেই সময় পুলিশও ওখানে লাঠিচার্জ শুরু করে এবং টিয়ার গ্যাস মারে। সেটা আবার আমি আবার পরে জানতে পেরেছি, ওই সময় জানতে পারিনি।
আমার কথা হচ্ছে যে এই রকম মুত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো, এটা..জানি না আমার.. আমি কখনও নিজের কথা ভাবিনি। আর আমি জানি মৃত্যু যে কোনো সময় আসতে পারে। সন্ত্রাসবিরোধী সভা। সেখানে আমরা সন্ত্রাসের শিকার হলাম।
সাধারণত আমরা আমাদের মিটিং করতে গেলে সরকারের থেকে পুলিশ ঘেরাও করে রাখে, কর্মীদের আসতে বাধা দেয়। আর সেই দিন কোনো প্রস্তুতি নাই। আরেকটা কথা হল, আমাদের পার্টির ভলান্টিয়ার, যারা সব সময় আমাদের মিটিংয়ে প্রত্যেকটা ছাদে ভলান্টিয়ার চলে যায়। সেদিন কিন্তু কাউকে যেতে দেয়নি। পুলিশ বাধা দিয়েছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে যে ব্যবস্থাটা নিই, সেটা কিন্তু তারা করতে দেয়নি।
অনুভূতির কথা আমি এটুকুই বলব যে আল্লাহ হয়ত আমার জীবনটা বাঁচিয়ে রেখেছেন কারণ এই রকম তো কয়েকবারই আমি এই ধরনের হামলার শিকার হয়েছি। হয়ত আমার হাত দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের কিছু কল্যাণ করবেন, সেজন্যই বোধহয় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
প্রশ্ন: এই নৃশংস হামলা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। যেভাবে এর ছক কষা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে পুরো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য এই হামলা করা হয়েছিল। এই জিঘাংসার কারণ কী?
শেখ হাসিনা: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগঠনটাকে গড়ে তুলেছিলেন এবং এই সংগঠন করবার জন্য তিনি মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান হওয়ার পরেই যেটা উপলব্ধি করেছিলেন যে বাঙালির জন্য একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র দরকার, বাঙালি জাতি হিসেবে একটা আত্মপরিচয় দরকার। যখনই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিলেন, তাকে কিন্তু গ্রেপ্তার করা হল এবং পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো।
কাজেই তাকে হত্যার একটা প্রচেষ্টা তো বহুদিন থেকে ছিল। তার কারণ হচ্ছে যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতির পিতার হাতে গড়া এবং এই আওয়ামী লীগকে নিয়েই তিনি বাংলাদেশের মানুষকে সুসংগঠিত করেছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেছেন। যারা আমাদের স্বাধীনতা চায়নি, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে বা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল, যারা পাকিস্তানি সরকারকে সাপোর্ট করেছে বা পাকিস্তানি সরকারের পদলেহন করত, তারা তো কখনও এদেশের স্বাধীনতাটা চায়নি। তাই আওয়ামী লীগের উপর তাদের ক্ষোভ এই জন্যই যে এই আওয়ামী লীগ সংগঠনটাই তো এদেশের মানুষের স্বাধীনতা, আন্দোলনে- সংগ্রামে এবং বিজয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং আওয়ামী লীগ প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে, সেই সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়। কাজেই সেই পরাজয়েই প্রতিশোধ তারা নিতে চেয়েছে সেজন্যই।
প্রশ্ন: তখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায়। হামলা পরবর্তী সময়ে তাদের আচরণ ছিল অত্যন্ত অমানবিক, বিশেষ করে তখনকার সরকার প্রধান খালেদা জিয়ার কথাবার্তা, আলামত নষ্ট করা, তদন্তের নামে প্রহসন, জজ মিয়া নাটক ইত্যাদি। তাদের এই আচরণকে আপনি কীভাবে আখ্যায়িত করবেন?
শেখ হাসিনা: দেখুন, খালেদা জিয়ার একটা... আমি বলব তার একেকটা বক্তৃতার মধ্য দিয়ে কিন্তু একটা মেসেজ যায়। সে যখন বক্তৃতা দিল যে আওয়ামী লীগ একশ’ বছরেও কোনোদিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, আরেকবার আরেক বক্তৃতায় বলল যে শেখ হাসিনা... ঠিক এই ২১শে অগাস্টের আগে তার বক্তৃতা, প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কোনোদিন হতে পারবে না। এই যে তার বক্তব্য এর মধ্য থেকেই তো বোঝা যায় যে তাদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল। আর এর সঙ্গে যে সরকারের সবাই জড়িত ছিল, এটা তো খুব স্পষ্ট। তার (খালেদা জিয়ার) কেবিনেটের মন্ত্রী সালাম পিন্টু সে এর সঙ্গে জড়িত, তখনকার ডিজিএফআই, এনএসআইর কর্মকর্তারা, পুলিশের কর্মকর্তারা, তাদেরকে নিয়েই কিন্তু এ সমস্তই চক্রান্তটা করে এবং সবথেকে বড় কথা হচ্ছে তার ছেলে তারেক রহমান। সে তো দীর্ঘদিন এই ষড়যন্ত্র তৈরি করা এবং এটাকে কার্যকর করার জন্য সব থেকে মুখ্য ভূমিকা তো সে তৈরি করেছে। খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই তার পেছনে ছিল এবং তাকে সমর্থন দিয়েছে। এবং এখানে আমি আরেকটা কথা আমি বলে রাখি এই ঘটনার আগে তারেক জিয়া কিন্তু ৫ নম্বর রোডে (ধানমণ্ডি) তার যে শ্বশুরবাড়ি, সেই বাড়িতে কিন্তু অবস্থান করেছে অনেকদিন বা কয়েকমাস। আর ঠিক অগাস্টের আগে সে ওই বাড়ি ছেড়ে আবার চলে যায় ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। এবং তখন আমার কাছে একটা খবর ছিল যে এই জায়গায় বসে সে কিছু একটা ঘোঁট পাকাচ্ছে।
যেমন রমনার বটমূলে যে বোমা হামলা সেটা, তারপরে উদীচীর মিটিংয়ে বোমা হামলা এবং এই রকম অনেকগুলো বোমা হামলা এবং আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাদের উপর হামলা। এই হামলাগুলো যে একে একে হচ্ছিল, সেই সময়টায় কিন্তু তারেক জিয়া ওখানে। হাওয়া ভবনটা মানে.. সেখানে যত রকম দুর্নীতির আখড়া আর এই ধরনের সমস্ত চক্রান্ত করা, এটাই ছিল তার কাজ।
গ্রেনেড হামলার পরে একটি গ্রেনেড, যেটা বিস্ফোরিত হয় নাই, সেই গ্রেনেডটা সেনা অফিসার একজন নিয়ে যায় এবং তার একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল এটা এটা রেখে দিতে হবে কারণ এটা এই মামলায় কাজে লাগবে। কিন্তু এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আমি শুনেছি যে খালেদা জিয়া নিজেই তাকে ধমক দিয়েছে যে না এটা করা যাবে না এবং এটাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
সিটি কর্পোরেশনের থেকে গাড়ি নিয়ে এসে ঘটনাস্থল ওই জায়গাটা পুরো ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে সমস্ত আলামত সরিয়ে ফেলে। সাধারণত এই রকম একটা ঘটনা ঘটলে সেখানে পুলিশ যায়, রেড টেপ দেয় এবং ওখানের সমস্ত আলামত সংরক্ষণ করে, আলামত সংগ্রহ করে। কিন্তু তাদের সেই ধরনের কোন প্রচেষ্টা ছিল না বরং সব আলামত ধ্বংস করে দেওয়া, মুছে ফেলার চেষ্টা। সেটা যখন তারা করে সঙ্গে সঙ্গে আমি আমাদের তখন যুবলীগে নানক ছিল, আযম ছিল, আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, ছাত্রলীগ, আমি বললাম ওরা এগুলো ধ্বংস করছে তোমরা শিগগির জায়গাগুলো সংরক্ষণ করো, চেষ্টা করো। যেখানে যেখানে গ্রেনেড পড়ে ছিল, ওরা পরে গিয়ে ওই জায়গাগুলো অন্তত চিহ্নিত করে।
এরপর একটা তদন্ত কমিশনের নামে একটা তামাশা। একটা তদন্ত কমিশন হল, সে দেখলো কী, পাশের দেশ থেকে এসে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। আমাদের দলের এতজন এমপি আহত, আইভি রহমান নিহত হয়েছেন, তাছাড়া আরও অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। আমাদের অনেকজন এমপি, তারা আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন। আমরা যারা ছিলাম, কথা বলতে চেয়েছিলাম, কথা বলতে দেবে না পার্লামেন্টে। এটা নিয়ে আলোচনাই করতে দেবে না। খালেদা জিয়া তো বলেই বসল, ওনাকে আবার কে মারতে যাবে। তারপরে তার এবং তার নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে উনি তো নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার হাতে তো ভ্যানিটি ব্যাগ ছিল না। আমি তো ব্যাগ ছাড়াই মঞ্চে উঠেছি। তাহলে গ্রেনেডটা আমি নিলাম কীভাবে? আর গ্রেনেড মারতে এত পারদর্শী কবে হলাম? আর এটা হলো আর্জেস গ্রেনেড, যেটা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এটা পাকিস্তানে থেকেই আসা, সেটা তো পরে তদন্তে বের হয়েছে।
কাজেই এসব থেকেই তো বোঝা যায় যে তাদের সম্পৃক্ততা। ওই দিন খালেদা জিয়া কোথায় ছিল? খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়া কিন্তু ঢাকায় ছিল না। একজন লক্ষ্মীপুরে আর একজন গোপালগঞ্জে। আর এই ধরনের জঘন্য কাজ। আর একটা দিনের বেলায় একটা রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য জনসভায় এই ধরনের হামলা আমার মনে হয় এটা পৃথিবীতে কোনোদিন হয়নি। এটা রণক্ষেত্রে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে যা ব্যবহার করে, তা তারা ব্যবহার করলো সাধারণ মানুষের উপর, একটা দলের উপর।
প্রশ্ন: ওই দিন যদি আপনাকে হত্যার মিশন সফল হত, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা হত আফগানিস্তানের মতো। মৌলবাদীরা এদেশ দখল করত। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার, অসাম্প্রদায়িক বাংলার স্বপ্ন অধরাই থেকে যেত। আপনার অভিমত কী?
শেখ হাসিনা: সবাই এটা বিশ্বাস করে, তার কারণ ওই সময় খালেদা জিয়ার আমলে যেভাবে সন্ত্রাসীদের মদদ দেওয়া হয়েছে। রাজশাহীতে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে বাংলাভাই মিছিল করছে আর পুলিশ তাদের পাহারা দিচ্ছে, আর বিএনপির অনেক নেতাকর্মীরা তাদেরকে মদদ দিচ্ছে। নাটোর, রাজশাহীর বহু নেতারা প্রকাশ্যে এদের মদদদানকারী।
পরবর্তী আপনি দেখেন, জঙ্গিবাদ যেভাবে— কারণ এরপরে কিবরিয়া (সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া) সাহেবের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে তাকে হত্যা করা হল। সুরঞ্জিত সেনের (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) মিটিংয়ে বোমা হামলা হলো, সিলেটে কামরানের (সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান) মিটিংয়ে আরেকবার বোমা, গ্রেনেড মারা হল। শুধু তাই নয়, এভাবে তো সারা বাংলাদেশে চলছিল।
একটা দিনে সারা বাংলাদেশে এই তো ১৭ই অগাস্ট সমস্ত বাংলাদেশে ৫০০টা জায়গায় বোমা হামলা হল। আমাদের ৬৪টা জেলার মধ্যে ৬৩টা জেলায় কিন্তু বোমা হামলা হয়েছে। ঢাকা সিটিতে ৩৫ জায়গায় বোমা হামলা হয়। সেই সময় আমি টুঙ্গিপাড়া। ঠিক ১১টার দিকে আমি একটা ফোন পেলাম। আমাদের একজন কর্মী দিনাজপুর থেকে ফোন করেছে যে আপা আমাদের এখানে বোমা হামলা। সাথে সাথে ঢাকাসহ আরও কয়েক জেলা থেকে বারবার ফোন আসছে। এমনকি, গোপালগঞ্জ থেকেও যে সেখানে বোমা হামলা। এই কথা শুনেই… আমার রওনা হওয়ার কথা ছিল দুপুরের পরে, আমি সাথে সাথে রওনা হয়ে গেলাম ঢাকায়। আমি ঢাকায় চলে আসলাম। আপনাদের একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করতে বলি একমাত্র মুন্সীগঞ্জে কিন্তু বোমা হামলাটা তখনও হয় নাই। আমার কিন্তু মুন্সিগঞ্জ থেকেই আসার কথা ছিল। তবে আমি এসেছিলামও মুন্সিগঞ্জ দিয়ে এটা ঠিক। কিন্তু ওরা সময়টা হিসেব করতে পারে নাই। কারণ আমার রওনা হওয়ার কথা টুঙ্গিপাড়া থেকে বিকাল ৩টা-৪টার দিকে। তো আমি মুন্সিগঞ্জ পৌঁছাতে বিকাল ৫টা-৬টা বাজবে। কিন্তু আমি রওনা হয়ে গিয়েছি ১১টায়। আমাকে অনেকে ফোনে মানা করেছে যে ঢাকার সব জায়গায় বোমা। কোথায় যে বোমা পড়বে ঠিক নাই। আপনি এই সময় মুভ কইরেন না, আপনি থাকেন। আমি বলি, এই সময় আমাকে ঢাকায় যেতেই হবে। আমাকে থাকতেই হবে ঢাকায়। কারণ এতগুলো জেলা থেকে খবর আসছে একটার পর একটা ফোন আসছে সমস্ত জেলা থেকে। তো এই সময় তো আমাকে ঢাকায় থাকতেই হবে। ঢাকায় না থাকলে তো আমি কিছু করতে পারব না। আমি সরাসরি রওনা হয়ে চলে আসি। ওটাও যদি কেউ একটু চিন্তা করে যে সব জেলায় হল ওখানে হল না। কারণ নিশ্চয়ই তাদের ওটা একটা প্ল্যান ছিল যে আমি যখন পার হব, তখন ওখানেই হবে, মারবে বা কিছু করবে। কারণ আমার যে সময় ফেরি ধরার কথা, আমার জন্য তো ফেরি স্পেশাল থাকল, ওটার একটা হিসাব তাদের ছিল। কিন্তু আমি তার আগেই চলে এসেছি। নরমাল যেই রাস্তা দিয়ে আসি, সেভাবে না এসে আমি এসে সোজা বিডিআরের ভেতর দিয়ে ঢুকে সুধা সদনে ঢুকি।
বিএনপি আমলে তো একটা সন্ত্রাসী দেশ করেই ফেলেছিল এবং এতে বহু লোক চলে যায় আফগানিস্তানে। তালেবানের ট্রেনিং নিয়ে। সেই মুফতি হান্নান নিজেই তো ট্রেনিং নিয়ে আসছে। তারপর এই তাজউদ্দিন, সেও তো ট্রেনিং নেওয়া। এ তো সব বিএনপির লোক। তাজউদ্দিন তো বিএনপির খাস এবং গ্রেনেড হামলার পর পর ওইদিন রাত ১১টার সময় চারজনকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে তুলে দেয়। বিশেষ ব্যবস্থায় তারা চলে যায় এবং সেখানে কিন্তু ডালিম আর রশীদও (বঙ্গবন্ধুর খুনি) ছিল।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার সাথে যে জিয়াউর রহমান জড়িত এবং তার স্ত্রী যে তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছে এবং ছেলেকেও সেই একই পথে নামিয়েছে, এটা তো স্পষ্ট।
প্রশ্ন: শুধু ২১শে অগাস্ট নয়, আপনাকে হত্যার জন্য ২০ থেকে ২২ বার হামলা করা হয়েছে। এই যে এতবার আপনার উপর হামলা, এত আক্রোশ কেন আপনার উপর? এরা কারা?
শেখ হাসিনা: আমি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ পা দেওয়ার সাথে সাথে আমি যেখানেই গেছি, সেখানে তো আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমি যখন খুলনা থেকে রাজশাহী রওনা হলাম, এত মানুষ! মানুষের ঢল সব জায়গায়। কারণ ১৫ই অগাস্টের পর মানুষ কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু আমি আসার পরে মনে হল মানুষের একটা জোয়ার চলে আসল। আমাদের পথে পথে মিটিং করতে করতে আমাদের এত সময় লাগলো যে রাত্রি ১১টার দিকে আমি ঈশ্বরদীতে গিয়ে মিটিং করি, যে মিটিং আমার বিকালে করার কথা। নাটোরে ঢুকব, নাটোরে আমার মঞ্চ ভেঙে দিল, আগুন দিয়ে পোড়াল। আমাদের নেতা-কর্মীদের ধান ক্ষেতে এখানে সেখানে মেরে ফেলে রেখে দিলে। এটা তো আমি যখন আসছি ওই সময়েই। আমি মে মাসে এসেছি— এটা বোধহয় জুন বা জুলাইয়ের ঘটনা। এইভাবে কিন্তু সব সময় তারা একটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে আমাকে।
১৫ই অগাস্টের পর আমাদের তো দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। জিয়াউর রহমান রেহানার পাসপোর্টটা রিনিউ করতে দেয়নি। যেহেতু আমি দিল্লিতে ছিলাম, বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন শামসুর রহমান সাহেব, সিএসপি অফিসার। আমাদের পাসপোর্টটা তিনি রিনিউ করে দিয়েছিলেন। তারপরে যখন আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে তখন তো আমি সিদ্ধান্ত নেই চলে আসবই। তারপর স্বাভাবিকভাবে ওই স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী তারপরে .. যে গোষ্ঠীটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে, গণহত্যা হত্যা করেছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে গেছে, মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করিয়েছে, যাদেরকে সমর্থন করেছে— এই শক্তিটাই তো জিয়ার আমলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
আমাদের সংবিধানে যেমন জাতির পিতা যেটা উপহার দিলেন মাত্র ৯ মাসের মধ্যে। সেখানে আমাদের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এগুলোতো আমাদের উল্লেখ করা ছিল। তখন এসে গেছে মার্শাল ল। মার্শাল ল তো আর গণতন্ত্র না। কাজেই গণতন্ত্রও চলে গেল, ধর্মনিরপেক্ষেতাও গেল, সমাজতন্ত্র গেল, সবই গেল। অর্থনৈতিক মুক্তি-টুক্তি সবই বাদ। এই যে পরিবর্তনটা এটা কাদের খাতিরে করা? কারণ এরা ওই পরাজিত পাকিস্তানি শক্তি। তাদেরই তোষামোদি-খোশামোদি, তাদেরই পদলেহনকারী।
যারা আমাদের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে বাংলাদেশের যে মূল আদর্শ, যেই লক্ষ্য— যে গরিবের জন্য কাজ করা, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, সেটাই তারা করতে চায়নি। বরং ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে একটা এলিট শ্রেণী তৈরি করে তাদের দিয়ে দেশ চালানো বা তাদের নিয়ে ক্ষমতায় থাকা। পাকিস্তানি একটা প্রদেশ হয়ে যাক আবার বাংলাদেশ, সেটাই ছিল তাদের মানসিকতা।
কারণ জিয়াউর রহমান তো পাকিস্তান আর্মিতে যোগদান করেছিল এবং তার বাপ-মার কবরও কিন্তু পাকিস্তানে। তারা কিন্তু ইন্ডিয়া থেকে পাকিস্তানেই চলে এসেছিল। তারা কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্বাস করত না। জিয়াউর রহমান কোনোদিন তা বিশ্বাস করেনি।
তার সাথে যারা আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এবং যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আমরা শাস্তি দিলাম। যাদের শাস্তি শুরু হয়েছিল, জিয়াউর রহমান এসে সেটা বন্ধ করে দেয় বিচার। বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে ক্ষমতায় বসায়। মন্ত্রী বানায়, উপদেষ্টা বানায়। সেই যুদ্ধাপরাধীরা তাদেরই রাজত্ব হয়ে যায়, তারাই দেশ চালায়। লাখো শহীদ যে রক্ত দিল যেই আদর্শ নিয়ে, লাখো শহীদ রক্ত দিল যেই লক্ষ্য নিয়ে, সেটা তো সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ইতিহাসই তো বিকৃত করা হয়ে গিয়েছিল।
আমি আসার পরে স্বাভাবিকভাবে আমি সেই বাস্তবতাটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সেই আদর্শটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করে দেশ যেন মর্যাদাপূর্ণ একটা দেশ হয়, সেই চেষ্টা করেছি। আর এদের প্রচেষ্টা ছিল যে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এটা যেন কোনোদিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারে। বাংলাদেশ কোনোদিন যেন আর বিশ্ব দরবারে মর্যাদা না পায় বা স্বাধীনতা যেন অর্থবহ না হয়। এটাই তো আসল উদ্দেশ্য ছিল। এটাই তো তাদের মূল। সেজন্যই তাদের এই প্রচেষ্টা ছিল।
আর আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে তো বাংলাদেশ আজকে এগিয়ে গেছে। আমরা যদি মাত্র ১২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে একটা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে পারি, জাতির পিতা যদি বেঁচে থাকতেন তো ৪০ বছর আগেই আমরা সেটা অর্জন করতে পারতাম, তো আমি এসে সেই আদর্শ নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু তারা তো সেটা চায়নি।
জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস করে যে তালেবান .. এবং সেই সময় কিন্তু একটা স্লোগানও চলত বাংলাদেশে, তারা স্লোগান দিত- ‘আমরা সবাই তালেবান বাংলা হবে আফগান’। আজকে আফগানিস্তানের অবস্থাটা দেখেই তারা দেখুক যে সেখানকার কী অবস্থাটা। সেটাই বাংলাদেশে করতে চেয়েছিল। যেটা হয়ত আমরা আছি বলে পারেনি।
এটা আমাদের দেশের মানুষকেও আরও বুঝতে হবে। বিশেষ করে আমি বলব আমাদের তরুণ সমাজকে ইতিহাস এবং শিকড়ের সন্ধান করে তাদেরকে সেই আদর্শ নিয়েই চলতে হবে, যেন এই লাখো শহীদের রক্ত বৃথা না যায়। আর এদেশের মানুষের জন্য তো আমার মা-বাবা সবাই জীবন দিয়ে গেছেন। আমার বাবার তো জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি তো যা কিছু করেছেন এদেশের মানুষের জন্যই করে গেছেন।
তো হ্যাঁ, বারবার আঘাত এসেছে। সেই ৮১ সালে আমি বাংলাদেশে নামার পর থেকেই আমার উপর হামলা হচ্ছে, আর আল্লাহ আমাকে কিভাবে যেন বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহ তো সবার জন্য কিছু কাজ লিখে দেয়, হয়ত কিছু আমার উপরে এই দায়িত্বটা আছে যে এই বাংলাদেশটার যেই মর্যাদা হারিয়ে গেছে, সেই মর্যাদাটা ফিরিয়ে দেওয়া। আর গবিব-দুঃখী মানুষের জন্য আমার আব্বা যে কাজ করতে চেয়েছিলেন, সেটা যেন হয়। এটাই বোধহয় আল্লাহর ইচ্ছা। আর সেটা যেন আমার হাত দিয়ে হয়। আল্লাহ সেটা চাচ্ছিলেন বলেই বারবার আমাকে হামলা থেকে বাঁচিয়েছে এবং এই যে আমি যতটুকু সফলতা অর্জন করছি বা যতটুকু বাংলাদেশের জন্য করতে পারছি বা বাংলাদেশের গরিবের জন্য করতে পারছি। এটাও আমি মনে করব যে একদিকে আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অপরদিকে বাংলাদেশের জনগণ এবং উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায়। তা না হলে আমার তো এদেশে থাকার কথা না।
এখানে খুনিরা অবাধে চলছে। জিয়াউর রহমান তাদের পুরস্কৃত করেছে, তাদেরকে সংসদ সদস্য করা হয়েছে, তাদেরকে বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেট করা হয়েছে এক খুনিকে। তো যেখানে এই রকম অবস্থা। রশীদকে খালেদা জিয়া এমপি বানালো। রশীদ এবং হুদাকে সংসদ সদস্য বানিয়ে নিয়ে আসল। ফারুককে এরশাদ প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেট করল। জিয়াউর রহমান তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে, কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করল। তো সেই দেশে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকে? এরা তো বাংলাদেশটাকে জঙ্গি রাষ্ট্রই করতে চেয়েছিল।
যাই হোক আমি দেশবাসীকে এটা বলব যে তাদের সচেতন থাকতে হবে। আমরা ওই আফগান হতে চাই না। বাংলাদেশ বাংলাদেশই হবে। বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
আল্লাহ যতদিন হায়াত দিয়েছে ততদিন বেঁচে থাকব। মৃত্যু তো অবধারিত। ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীড় হায়রে জীবন নদে’- এটা তো কবি বলে গেছেন। আর সেটাই আমি মনে করি। একবার যখন জন্মেছি, মরতে হবেই। আজকে মরি, কালকে মরি, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ যেদিন জীবন দিয়েছেন, আল্লাহ যেদিন ইচ্ছা জীবন তুলে নেবেন। কাজেই এ নিয়ে আমার কোনো দুঃশ্চিন্তা নাই। আমি একটাই চিন্তা করি সকালে উঠে ভাবি একটা দিন পেলাম। অন্তত দেশের মানুষের জন্য একটু কাজ করতে পারব। ব্যাস, এইটুকুই।
প্রশ্ন: আপনার উপর এতবার হামলা হল। এসব হামলা, হুমকি, ধমকিকে আপনি তোয়াক্কা না করে আপনার লক্ষ্য থেকে আপনি বিচ্যুত হননি। এই যে শক্তি, এতটা সাহস এটা কোত্থেকে পেলেন? এর উৎস কী?
শেখ হাসিনা: এটা আমার আব্বার কাছ থেকে শিখেছি, মার কাছ থেকে শিখেছি।
এই দেশের যে মানুষ ক্ষুধার্ত, তাদের ছিন্ন কাপড়, তাদের ঘর নাই, তাদের চিকিৎসা নাই, তাদের শিক্ষা নাই। আমি ৮১ সালে এসে সারা বাংলাদেশ যখন ঘুরেছি, ওই একই দৃশ্য। ঠিক যেই দৃশ্য দেখে আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু তাকে তো করতে দেওয়া হলো না। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে তিনি যখন দেশটাকে কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেই সময় কিন্তু ঘাতকের দল হত্যাটা করল। কারণ তারা দেখলো যে এই বাংলাদেশকে আর থামানো যাবে না। তাকে শেষ করে দিল অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শেষ করতে পারলেই আটকানো যাবে। ঠিক সেটাই হল। ২১টা বছর বাংলাদেশের মানুষের কী অবস্থাটা ছিল? কোনো পরিবর্তন তো হয়নি। তারপরে আমরা সরকারে আসার পর থেকে যখন কাজ করেছি, আস্তে আস্তে সেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সরকার জনগণের সেবক, ঠিক সেই সেবা আমরা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে বাংলাদেশকে আমরা অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল করতে পেরেছি এবং আজকে আমাদের সব থেকে লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচন। মুজিববর্ষ আমরা উদযাপন করছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি উদযাপন করছি। আমার তো একটাই কথা যে একটা মানুষ গৃহহারা থাকবে না। এখানে শক্তি সাহসটা হচ্ছে এটা আমার মনের শক্তি, যেটা ছোটবেলার থেকে বাবা-মায়ের কাছে শিক্ষা। আর আল্লাহর উপর ভরসা রেখেছি সব সময়। আর বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি বা তাদের যেই সমর্থনটা আমি পেয়েছি। কারণ বাবা-মা-ভাই-বোন সব হারিয়ে যখন একা আসলাম আমার ছোট দুটো বাচ্চাকে আমি রেহানার কাছে দিয়ে আসলাম। একজন ১০ বছরের, একজন ৮ বছরের। তাদের তো মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করেছি। আমি আসলাম বাংলাদেশের জনগণের জন্য। তো আমি বলবো যে আমার শক্তি বাংলাদেশের জনগণ, আমার সাহস আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, আর শিক্ষা আমার বাবা-মায়ের।
প্রশ্ন: ২১শে অগাস্ট যারা নিহত হয়েছিলেন, তাদের পরিবারবর্গ বা যারা আহত হয়েছিলেন, তাদের জন্য আপনারা কী কী কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন?
শেখ হাসিনা: প্রত্যেকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, যারা মারা গিয়েছে, সেই পরিবারকে সাহায্য করা। বিদেশে পাঠিয়ে পাঠিয়ে আমরা সব চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। ধন্যবাদ সেই সময় যারা এগিয়ে এসেছেন, আমাদের ফান্ডে টাকা দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে আমি তাদেরকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য টাকা দিয়ে যাচ্ছি। অনেক পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি। যারা মারা গেছে, ঢাকা শহরে তাদের সবাইকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছি। তাছাড়া যারা নিজের দেশে আছে, ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়া … তাদের জীবন-জীবিকার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা, সব রকম সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে পরবর্তীতে যারা আহত ছিল অনেকেই মারা গেছে। কিন্তু তারপরও তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য যা যা সহযোগিতা করা আমরা করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: আজকে ২১শে অগাস্টের এই বিয়োগান্তক দিনে দেশবাসীর উদ্দেশে কিছু বলুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা: আর দেশবাসীকে এটাই বলব আমি যে বেঁচে আছি, ব্যাস এটাই সত্য, আর যতক্ষণ বেঁচে আছি, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাব। কারণ আমি তো দেশের মানুষের কাছে ওয়াদা দিয়েছি, যেভাবে এই বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমার বাবা-মা জীবন দিয়ে গেছেন, এদেশের মানুষের জন্য আমি সেভাবে আমার জীবন দিতেও সব সময় প্রস্তুত। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, তাকেই ভয় করি এবং তারই দোয়া আর জনগণের সমর্থন, জনগনের দোয়া নিয়েই আমি চলি।
কাজেই আমার এই পথ চলায় আমার একটাই লক্ষ্য যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে এই বাংলাদেশকে একটা উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী বাংলাদেশ করব, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমর বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেখেছিলেন। সেটাই আমি করতে চাই। কাজেই সেক্ষেত্রে দেশবাসীর সহযোগিতা চাই, দোয়া চাই এবং সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সেটাই আমি চাই।