নিজের স্বাস্থ্য রক্ষায় ধুমপান থেকে আপনি বিরত, তার মানে আপনি বেশ সচেতন। কিন্তু আপনার এ সচেতনতা আসলে কতোটা কাজে দিচ্ছে সেটি কি কখনো ভেবে দেখেছেন? বিশেষ করে, যখন আপনি দিল্লী, লাহোর কিংবা ঢাকার মতো শহরের বাসিন্দা। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো, এসব শহরে বাস করা মানে ধুমপান না করেও দৈনিক ১০/১৫ টি সিগারেটের সমপরিমাণ বিষাক্ত ধোঁয়া গলদকরণ করা! ফলে, এসব শহরে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেওয়া মানে প্রতি শ্বাসে নিজের ভেতরে ফুসফুস ক্যান্সার, হৃদরোগসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করা।
দক্ষিণ এশিয়ার এসব বড় বড় শহরের দীর্ঘ সময় ধরে এই ভয়াবহ আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে আসছে। আর এই আক্রমণ করোনা ভাইরাসের আক্রমণের চেয়েও ভয়াবহ। ধারণা করা হয়, ভয়াবহ বায়ুদূষণে কেবল দিল্লীতেই বছরে অন্তত ৫৪ হাজার মানুষ অকালে মারা যান, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। আর যদি আমরা বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখব যে, কেবল ঢাকায় বসবাসের কারণেই এর অধিবাসীদের আয়ু অন্তত গড়ে সাত বছর করে কমে যায়! এবং সারাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে এই আয়ু কমার হার ৫ বছর ৪ মাস!
পাকিস্তানী সাংবাদিক হামিদ মীর ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক নিবন্ধে জানাচ্ছেন, তিনি পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে খ্যাত লাহোরে সম্প্রতি এক পার্টিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেখতে পান যে, এমন কোনো মূহুর্ত বাকী ছিল না যেখানে কেউ না কেউ কাশি দেয়নি। সে সময় হামিদ মীরকে তারই এক সহকর্মী যত দ্রুত সম্ভব লাহোর ত্যাগ করার পরামর্শ দেন। সেই সাংবাদিক লাহোরকে ‘গ্যাস চেম্বার’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
হামিদ মীরের সেই সহকর্মী আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে তাকে আরও বলেছিলেন, রাতের আকাশে একটু কষ্ট হলেও আপনি তারা ঠিকই পাবেন, কিন্তু দিনের বেলায় একটু ওপর দিয়ে ওড়ে যাওয়া চড়ুই পাখিটাও দেখতে পাবেন না।
আমাদের ঢাকার অবস্থা যে খুব একটা ভালো, তা বলা যাবে না। কেননা চলতি বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষ তিন-এ রয়েছে ঢাকার নাম। গত ২০ নভেম্বর রাজধানীর বাতাসের গুণমান সূচক (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই) ১৮২ রেকর্ড করা হয়েছে। যা “অস্বাস্থ্যকর” হিসেবে বিবেচিত। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের লাহোর এবং ভারতের দিল্লি যথাক্রমে ৪০৭ এবং ৩১১ একিউআই স্কোর নিয়ে তালিকার প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ফলে, এই পরিস্থিতিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কোন সুযোগ নেই। কেননা এই এর আগে, গত ২৩ অক্টোবর সকাল ৯ টা ১৫ মিনিটে ঢাকার বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) ১৫৯ রেকর্ড করা হয়েছিল। এক মাস হওয়ার আগেই তা বেড়ে ১৮২-তে এসেছে। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার বাতাসের গুণগত মানসূচক (একিউআই) ছিল ২৩৫। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বাতাসের অবস্থা ভয়াবহভাবে ক্রমাবনতির দিকেই যাচ্ছে।
সাধারণত ১০০ এবং ২০০-এর মধ্যে একিউআই ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ বলে বিবেচিত হয়। একইভাবে ২০১ এবং ৩০০-এর মধ্যে ‘খুবই খারাপ’ বা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে বিবেচিত হয়। সুতরাং, ঢাকার বাতাস ‘খুবই খারাপ’ এবং তা শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসের সমস্যা আছে এমন মানুষের জন্য বেশ বিপজ্জনক। কেবল ঢাকা নয়, সারাদেশেই বায়ুদূষণের অবস্থা প্রকট এখন।
বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন, বায়ু দূষণের কারণে ভারতীয়দের গড় আয়ু কমেছে অন্তত ৯ বছর এবং পাকিস্তানীদের ৪ থেকে ৭ বছর। বায়ু দূষণে বাংলাদেশিদের আয়ুও কমেছে ৫ থেকে ৭ বছরের মতো।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভারতীয় উপমহাদেশের এই তিনটি দেশের নেতারা জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলেও কার্যকর পদক্ষেপ খবু কমই দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপদগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে। কিন্তু বিদেশি জলবায়ু তহবিল থেকে যে অর্থ ছাড় করার কথা ছিল সেটা নিয়েও গড়িমসি চলছে।
সরকারের তরফ থেকে টেকসই ও সবুজ উন্নয়নের কথা বলা হলেও, নানা কারণে সেসব উদ্যোগ কোন ক্ষেত্রে মন্থর গতিতে আবার কোন ক্ষেত্রে কোন উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়াই থমকে থেকেছে। শিল্পায়ন-নগরায়নের কারণে বাংলাদেশে এবং ভারত-পাকিস্তানে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পরিকল্পনা বাঁধগ্রস্ত হয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার চাপ এবং বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাল মেলাতে গিয়ে পরিবেশগত দিকটি বারবার উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং খোদ উন্নত দেশগুলো। তারা বারবার ব্যবসায়িক স্বার্থে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোতে প্রযুক্তি হস্তান্তর থেকে বিরতে থেকেছে। ফলে উন্নয়নের প্রবাহ ঠিক রাখতে গিয়ে পরিবেশ দূষণও সমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলে এই ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণের কারণে সারাবিশ্বে ফুসফুস এবং বায়ুদূষণের কারণে অন্যান্য রোগে যতো মানুষ মারা যায় এবং যে পরিমাণ মানুষের আয়ু কমতে থাকে তা কোনভাবেই কোভিড সংক্রমণের চেয়ে কম নয়। ২০১৮ সালের বিবিসির এক প্রতিবেদেন বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণ জনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। সেই তুলনায় যে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাটা খুব বেশি নয় তা সহজেই অনুমেয়। ২০১৯ সালে কোভিড সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে ২৮ হাজারের কিছু বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন। একই সময়ে, কেবল ২০১৯ সালেই বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন মারা গিয়েছেন বলে উঠে এসেছে ঢাকা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যার তুলনায় বায়ু দূষণে মৃত্যুর হার প্রায় ৬ গুণ বেশি।
বায়ু দূষণের এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে হলে, এখনই অপরিকল্পিত নগরায়ন, কৃষি জমি ব্যবহার করে শিল্প এবং নগর সৃষ্টি, বনভূমি ধ্বংস ইত্যাদি নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। শহরের ভেতরে সবুজায়ন, গ্রাম সংরক্ষণ, বন সংরক্ষণ, কৃষি জমি রক্ষাসহ শিল্প কারখানায় পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা-প্রযুক্তি নিশ্চিতকরণ করতে হবে এখুনি। দেরি করার কোন সুযোগ নেই। দেরি করলে করোনা ভাইরাস নয়, বায়ু দূষণই বাঙালির জন্য সবচেয়ে বড় হন্তারক হয়ে আবির্ভূত হবে।