জীববিজ্ঞান বইয়ে পবিত্র কোরানের আয়াত!

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ১৭, ২০২১, ০৬:৩৬ এএম

জীববিজ্ঞান বইয়ে পবিত্র কোরানের আয়াত!

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জীববিজ্ঞান প্রথমপত্র বইয়ে পবিত্র কোরানের আয়াত যুক্ত করায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন শিক্ষার্থী-শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাবিদ ও গবেষষকরা বলছেন, বিজ্ঞান বইয়ে প্রসঙ্গ ছাড়াই ধর্মগ্রন্থের বাণী যুক্ত করায় সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ আবুল হাসানের লেখা বইটির প্রকাশক হাসান বুক হাউজ। বেসরকারিভাবে প্রকাশিত ২০২১ সালের আগস্ট সংস্করণে সংযোজিত হয়েছে সূরা বনী-ইসরাঈলের একটি আয়াত৷

এ বছর বইটির তৃতীয় পৃষ্ঠায় জীবনের সংজ্ঞায়ন সম্পর্কে 'জীবন' নামে একটি নতুন পাঠ্য বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। যেখানে লেখা রয়েছে, "দেহে আত্মা, প্রাণবায়ু বা রুহ্ থাকা অবস্থায় দেহ জীবিত, না থাকলেই দেহ মৃত। কাজেই আত্মা প্রাণ বা রূহ্-ই জীবন।" 

এই সংস্করণে আদি কোষের সৃষ্টি ও বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আলোচনার মাঝে জীবনের ব্যাখায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কোরানের বনী-ইসরাঈল সূরার ৮৫ নম্বর আয়াত। বইটিতে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, "রুহ্ স্রষ্টার আদেশঘটিত বিষয়। ক্বলি রূহ মিন আমরি রাব্বী-বলুন, রূহ্ আমার পালনকর্তার আদেশঘটিত বিষয়"।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লেখকের প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক উদ্ভিদবিজ্ঞান বইটি ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সকল বই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি কর্তৃক অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হলে বইটি অনুমোদন লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমেও আবার এনসিটিবির অনুমোদন লাভ করে বইটি। শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশ করে যাচ্ছেন লেখক যা ইতোমধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাঝে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছে।

২০২১ সালের সর্বশেষ নবম সংস্করণে জীবন প্রসঙ্গে আলোচনায় পবিত্র কোরানের আয়াত যুক্ত করায় হতাশ হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ড.মোহাম্মদ আবুল হাসানের জীববিজ্ঞান বইটি পড়েছেন এমন অনেকে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পেশাগত দায়িত্বে আছেন। অনেকে বিশ্বাস করতেই পারছেন না আবুল হাসানের লেখা বইয়ে এমন কিছু থাকতে পারে। বিজ্ঞান বিষয়ে জীবনের ব্যাখ্যায় হঠাৎ পবিত্র কোরানের আয়াত যুক্ত করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না তারা। বিস্মিত হয়েছেন বিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়নে নিযুক্ত বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষাবিদরা।

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, আমাদের কাছে অনুমোদিত সকল বইয়ের পান্ডুলিপির কপি রয়েছে। অনুমোদনের আগে শিক্ষাবিদরা সেটা মূল্যায়ন করেন। অনুমোদনের সাথে রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম সম্পর্কে বিতর্কিত কোনকিছু যুক্ত না করার পরামর্শ দেওয়া হয় সকল প্রকাশককে।

এনসিটিবি সূত্রে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এই বছর ২৯ জুন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবির ৭০৩ তম জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার ২ নং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০টি বিষয়ে মোট ১৮টি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের অনুমোদন দেয় এনসিটিবি। যেখানে জীববিজ্ঞান প্রথম পত্র প্রকাশের অনুমোদন পেয়েছে চ্যান্সেলর পাবলিকেশন। এনসিটিবি সুত্র অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারিভাবে অনুমোদিত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রকাশিত বইয়ের প্রকাশকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় বেসরকারিভাবে বাজারজাতকৃত বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্য পুস্তকের পৃষ্ঠা সংখ্যা বৃদ্ধি ও মূল্য বৃদ্ধি করার কারণে ছয়টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের সুপারিশ করা হয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সংখ্যা বৃদ্ধির অভিযোগে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ রয়েছে হাসান বুক হাউজের জীববিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ের প্রকাশিত দুইটি বই প্রকাশের বিরুদ্ধে। এছাড়া লেকচার পাবলিকেশন, সিস্টেক পাবলিশার্স,অক্ষরপত্র প্রকাশনী, বাশার প্রকাশনী, নাবিশা প্রকাশনি, কোয়ালিটি প্রকাশনীর নাম রয়েছে সুপারিশের তালিকায়।

এনসিটিবির অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও কেন অনুমোদিত লিখে বাজারে বই ছেড়েছেন জানতে চাইলে হাসান বুক হাউজের প্রকাশক ড. ভক্তিময় সরকার বলেন, এইটা এনসিটিবির অনুমোদিত বর্ধিত সংস্করণ। এভাবেই একাধিক প্রকাশনা সংস্থাসহ (নাম উল্লেখ করেছেন) আমরা বই প্রকাশ করে থাকি৷

তিনি বলেন, স্যার (বইয়ের লেখক) ফোন করে বলেছেন, যদি পবিত্র কোরানের আয়াত ব্যবহার (জীববিজ্ঞান বইয়ে) ঠিক না হয় আমরা সরিয়ে নেবো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, অনুমোদন না নিয়েই অনেক প্রকাশক এইভাবে বই প্রকাশ করে যাচ্ছে। অনেকসময় নির্ধারিত বইয়ের একটা বিকল্প সংস্করণ তৈরি করে এনসিটিবিতে পাঠান আবার বাজারে ছাড়েন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা কপি। বাজারে ছাড়া সংস্করণে দেখা যায় বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা এবং মূল্য বৃদ্ধি করার নজির। ব্যবস্থা গ্রহনের ক্ষেত্রে আবার বই প্রকাশ না করার হুমকিও আসে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। ফলে ইচ্ছা থাকার পরেও উপায় মিলে না।

বেসরকারিভাবে প্রকাশিত উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর জীববিজ্ঞান প্রথমপত্রের লেখক ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, এই সংস্করণে কোরানের একটি আয়াত নতুন সংযুক্ত করা হয়েছে৷ কোরান সম্পর্কে মানুষের জানা দরকার এইজন্য। আমি ধর্ম সম্পর্কে গোড়া মানুষ না, লিবারাল মানুষ।

বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনায় কোরানের আয়াত যুক্ত করার যৌক্তিকতা জানতে চাইলে তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, 'দুই দিকেই ব্যাখা আছে। কোরানই বিজ্ঞান, বিজ্ঞানই কোরান৷ সবকিছুই বিজ্ঞানময়, কোরান ছাড়া সাধারণ জীবন চলে না। আবার যারা কোরান ছাড়া বিজ্ঞান চর্চা করেন তাদের দিকদিয়ে না আনলেও চলে। আমি এইটা নিয়া তর্কে যাবো না। সবাই যদি বলে আমি বাদ দিয়া দেব। সে (ধর্মীয় প্রচারের) উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা হয়নি।'

বিজ্ঞান বইয়ে কোরানের আয়াত যুক্ত করার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না উল্লাখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, বিজ্ঞান বইয়ে কোরানের আয়াত কোনভাবেই আসতে পারে না। ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের জায়গা, বিজ্ঞান চলে যুক্তিতে। একটার সাথে আরেকটা মেলানো যাবে না। ফিজিক্সের থিওরিতে যদি কোরানের ব্যাখ্যা আলোচনা করি তাহলেতো আমাদের কিছু শেখা হবে না। আমরা পিছিয়ে যাবো তো। আমরা নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারবোব না তো। ধর্ম, ধর্মের জায়গায়,বিজ্ঞানের জায়গায় বিজ্ঞান। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার বইয়ে এই বিষয়টি বিজ্ঞান বইয়ে যুক্ত করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এইটা কীভাবে সম্ভব! খুবই লজ্জাজনক। মানুষ হাসাহাসি করবে।

Link copied!