ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২২, ০৮:২২ এএম
যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে দেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি-জামায়াত যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে। অন্যদিকে, এ অভিযোগকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে নাকচ করে দিয়ে বিএনপি বলেছে, লবিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারই নিয়োগ দিয়েছে। এদেশের গণতন্ত্র হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি লুণ্ঠন যাতে ধামাচাপা দেওয়া যায় সেজন্য তারা গত ১৪ বছর যাবত লবিস্ট নিয়োগ করেছে।
লবিস্ট নিয়োগ করা-নাকরা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এবং কূটনীতিকরা বলছেন, দেশের স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে লবিস্ট নিয়োগ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। পাশাপাশি র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উঠাতে করণীয় ঠিক করতে প্রধান দুই দলকে আলোচনার টেবিলে বসার আহবানও জানিয়েছেন তারা।
গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চারটি এবং ২০১৯ সালে একটি ‘লবিস্ট ফার্ম’ নিয়োগ করে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত-বিএনপিও তিনটি ‘লবিস্ট ফার্ম’ নিয়োগ করেছিল।
মোমেন আরও বলেন, “লবিস্ট ফার্মকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে সহায্য সহায়তা বন্ধ করে দিতে বলেছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, উন্নয়ন যাতে ব্যাহত হয়, তার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বলছে ওই দলটি।”
এর আগে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগে লাখ লাখ ডলার খরচ করছে বলে অভিযোগ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
আওয়ামী লীগের এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, তাদের দল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কোন লবিস্ট নিয়োগ করা হয়নি। বরং সরকার তাদের সকল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আড়াল করতে এবং দুঃশাসনকে প্রলম্বিত করতে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কৌশল হিসেবে লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পালটা অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার এদেশের গণতন্ত্র হত্যা করছে। তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন, চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি লুণ্ঠন করছে। এগুলো যাতে ধামাচাপা দেওয়া যায় সে জন্য তারা বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে গত ১৪ বছর যাবত।”
তবে দেশের স্বার্থ বিবেচনা না করে বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ একদমই ঠিক হয়নি বলে মনে করেন বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ওয়ালিউর রহমান।
বিভিন্ন অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশের সরকার যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থিক আনুকূল্য পেতে লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। এ বিষয়টি উল্লেখ করে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে তিনি বলেন, “বিরোধী দলে থেকে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিএনপি যে লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তা স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”
মুক্তিযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক তৈরি করতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পাওয়া এই কূটনীতিক আরও বলেন, “২০১৩ সালে মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন টাইমসে বেগম খালেদা জিয়ার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই নিবন্ধে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিলসহ আর্থিক সহায়তা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অনুরোধ করেন বেগম খালেদা জিয়া। ওই সময় থেকেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করে।”
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে সাবেক এই সচিব আরও বলেন, “র্যাব গঠন করেছে বিএনপি। র্যাবকে প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন মার্কিন প্রশাসন যদি নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে তাদের উচিত হবে র্যাবকে ডেকে নিয়ে কী করা উচিত-অনুচিত তা বলে দেওয়া। তাহলে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, একটি বিষয় হলো লবিস্ট নিয়োগ অবৈধ কিছু নয়। তবে যদি বিরোধী দল লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে, তাহলে কিছু প্রশ্ন তো অটোমেটিক চলে আসে। বিশেষ করে বিরোধী দল টাকাটি কিভাবে লবিস্টদের দিলো? যদি দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা কি নিয়ম মেনে দেওয়া হয়েছিল? আমরা তো জানি বিদেশে টাকা পাঠানোর ওই ধরণের বিশেষ কোনো নিয়ম নেই।”
আওয়ামী লীগের লবিষ্ট নিয়োগ বিষয়ে এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক আরও বলেন, “বেশিরভাগ দেশের সরকারই সুবিধা পেতে লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। বিএনপি দাবি করেছে আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। তাদের দাবি সত্য হলে আওয়ামী সরকার হয়তো দেশের উন্নয়নে মার্কিন সহায়তা অব্যাহত রাখতে ওই লবিষ্ট নিয়োগ করেছে। এটি ভাল। তবে এর জন্য স্বচ্ছতা থাকতে হবে। জনগণকে জানাতে হবে আসলে কী উদ্দেশ্যে তাদের এই লবিস্ট নিয়াগ।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, “ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন, রাজনীতি, ক্ষমতায় টিকে থাকাসহ সবখানেই লবিস্ট নিয়োগের প্রবণতা আছে। আইনও আছে। এটা রাষ্ট্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সবাই করে তার বা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য।”
আওয়ামী লীগের লবিস্ট নিয়োগ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এ কে এম আতিকুর রহমানও মনে করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যাতে পাকিস্তানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বানচাল করতে না পারে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার জন্য লবিস্ট নিয়োগ উচিত ছিল। তবে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার পেছনে বিএনপির নিয়োগ করা লবিস্ট কাজ করেছে বলে তিনি মনে করেন না।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক এই হাইকমিশনার বলেন, “এটি অস্বীকার করলে চলবে না মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিতে র্যাবের বিরুদ্ধে অলোচনা চলছে। আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো এটা করছে হয়তো র্যাব যাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এটি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনে। বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় কারণ হতে পারে না। কারণ র্যাব সৃষ্টি করেছে আমেরিকাই।”
তবে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধের পক্ষে একমত সব বিশেষজ্ঞ-কুটনীতিক। পাশপাশি র্যাবের ওপর আরোপ করা মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে দেশের এই প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।