প্রতিনিয়ত নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, ঝুঁকিতে দেশ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ২২, ২০২২, ০৫:৪৪ এএম

প্রতিনিয়ত নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, ঝুঁকিতে দেশ

বিশ্বে মানুষ বাড়ছে, বাড়ছে পানির ব্যবহার। মানুষ প্রতিনিয়ত সুপেয় পানির অপব্যবহার করছে। মাটির ওপরকার পানি ব্যবহার করতে করতে তারা ভূগর্ভস্থ পানির দিকেও ছুটছে। ভূগর্ভস্থ পানির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে পানির সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। দেশেও এই সংকট দিনকে দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। 

সেচের জন্য অপরিকল্পিতভাবে গভীর ও অগভীর নলকূপ দিয়ে মাটির নিচের পানি উত্তোলন করায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। গবেষকরা বলছেন, প্রতি বছর ঢাকাতেই পানির স্তর ১ মিটার থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যায়। গত ৫০ বছরে ঢাকার পানির স্তর এভাবে নেমে গেছে প্রায় ৭০ মিটার। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। সঙ্কট মোকাবেলায় মাটির উপরিভাগের পানির ব্যবহার বাড়ানোর দাবি তাদের।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। এই সংকট আগামী কয়েক দশকে আরও খারাপ হতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ পানিসংকটে ভুগতে পারে। বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের চলতি বছরের পানি উন্নয়ন প্রতিবেদনে এসব তথ্য এসেছে। গতকাল সোমবার ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

‘পানির অপর নাম জীবন’, আমরা প্রায়ই এ কথাটি শুনে থাকি। এছাড়া, টেকসই উন্নয়ন এবং পানি, এ দুটি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পানি ছাড়া যেমন জীবন অচল, তেমনি জলবায়ু ও প্রকৃতি যা জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্যও পানি অপরিহার্য।

আজ মঙ্গলবার ‘বিশ্ব পানি দিবস।’ বাংলাদেশে এবার প্রথম জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে সারা দেশে দিবসটি পালিত হবে। বিশ্ব পানি দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘ভূগর্ভস্থ পানি-অদৃশ্য সম্পদকে দৃশ্যমান করা’।

দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষ্যে আরও একবার দেশে পানিসম্পদের ব্যবহার উঠে এসেছে এই আলোচনায়।

বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে আনুমানিক ৩২ লাখ ঘন কিমি পানি উত্তোলন করা হয় বিভিন্ন কাজের উদ্দেশ্যে। মোট উত্তোলনকৃত পানির ৯০ শতাংশই ব্যবহার করা হয় কৃষিজ সেচ কাজে, বাকি ১০ শতাংশ ব্যবহার করা হয় গার্হস্থ্য এবং শিল্প কারখানায়।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের করা ২০১৯ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে অগভীর সেচ কূপের সংখ্যা ১৯৮৫ সালে ১৩৩,৮০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১,৬০০,০০০ এ উন্নীত হয়েছে।

ভূগর্ভস্থ পানির বর্ধিত আহরণের কারণে, সময়ের সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচের দিকে নেমে এসেছে এবং শহরাঞ্চল ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তরের স্থায়ী হ্রাসও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।

বরেন্দ্র অঞ্চল দিনাজপুরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে। গণমাধ্যমকে দেয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৯ থেকে ১০ ফুট নিচে নেমেছে। জেলায় বর্তমানে ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট নিচে পানি পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে তিন বছর আগেও ২৫ থেকে ৩৫ ফুট নিচে পানি পাওয়া যেত।

এছাড়াও, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেশের সবচেয়ে উঁচু জেলা দিনাজপুরে মিলছে মরুকরণের নানা লক্ষণ। পানির স্তর নিচে নামা ছাড়াও, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৭.৫০ মিটার উচ্চতার এ জেলার নদীতে জেগেছে চর। এছাড়া মরুকরণের ইঙ্গিত বহনকারী উদ্ভিদ সূর্য শিশিরের দেখাও মিলেছে।

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় মাটি থেকে পানি উত্তোলন ব্যয়বহুল ও দুঃস্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। এছাড়াও, বিশ্বব্যাঙ্ক ২০১৯ সালে আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, ২৪ শতাংশ এলাকা উচ্চতর আর্সেনিক আক্রান্ত, লবণাক্ততা এবং ভূগর্ভস্থ পানি হ্রাসের কারণে বাংলাদেশ অত্যন্ত উচ্চ থেকে উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষ্যে FANSA-Bangladesh- এর আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল সেমিনারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, পানির প্রাথমিক ও মূল্যবান উৎস হল ভূগর্ভস্থ পানি । কিন্তু পানির অযৌক্তিক আহরণ এবং মানবসৃষ্ট দূষণ যেমন বন উজাড়, শিল্প, কৃষি ও পশুপালন, পয়ঃনিষ্কাশন, ঝড়ে সৃষ্ট পানির প্রবাহ, তেল দূষণ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, রোগজীবাণু, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ইত্যাদির কারণে পানির স্তর ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

এ সময় তিনি পরামর্শ দেন, ন্যাশনাল ওয়াটার পলিসি ১৯৯৯ এবং সরকারের অন্যান্য নির্দেশিকা অনুসারে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি ব্যবহার এবং সমন্বিত ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া উচিত।

সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময়ে ভূগর্ভস্থ পানির ওপরে চাপ কমানোর ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে তাদের মতামত প্রদান করেছেন। সম্প্রতি, ভূগর্ভস্থ পানির প্রতি চাপ কমাতে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দৈনন্দিন কাজ ও শিল্প কারখানায় সারফেস ওয়াটার বা পুকুর-দিঘি, খাল-বিল, নদ-নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো এবং রিসাইকেলের আহ্বান জানিয়েছেন।

সম্প্রতি সচিবালয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘বিশ্ব পানি দিবস-২০২২’ এর উদযাপন উপ কমিটির পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশের নদীগুলো একে একে মরতে শুরু করেছে। নদীর তলদেশ ভরে উঠে প্রায় সব নদীই হয়ে পড়েছে পানিশূন্য। অযত্ন আর অবহেলায় নদী মরে যাওয়ায় সুফল তো মিলছেই নয় উল্টো দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূষণে আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে দেশের ছোট বড় মিলে তিন শতাধিক নদী। এছাড়াও, সভায় ভারতের কাছ থেকে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা পাওয়া এবং নদী জবরদখলের ওপরেও বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

Link copied!