সৈয়দ মুজতবা আলীকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন বাংলা সাহিত্যের কুতুব মিনার। আর আমরা বলতে পারি বাংলাদেশের তারুন্যের সাংবাদিকতার মিনার হচ্ছেন মিনার মাহমুদ। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক ইাতহাসে মিনার মাহমুদ একটি অমোচনীয় নাম। তাকে একাধারে স্মার্টগদ্যে নির্ভীক তথ্য প্রবাহের জনকও বলা চলে। একটি নতুন সৃষ্টির উম্মাদনা তাকে সর্বদা তাড়িত করেছিল নিরন্তর সৃজনশীলতায়।
তারুণ্য দৃপ্ত পদচারণার জীবন যাপনের লাল মোরগের ঝুঁটির মতো লাল মোটরবাইক দাবড়ানো মিনার মাহমুদ। মফস্বল ফরিদপুর থেকে গল্পকার হওয়ার স্বপ্নে আসা ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ খ্যাত মিনার মাহমুদ সাপ্তাহিক বিচিত্রায় খোচান ক্যান? কিসের বিতর্কিত আমি...? দিয়ে সাংবাদিকতায় নিজের আগমন জানান দিয়েছিলেন তার স্বমহিমাতেই।
১৯৮৭ সালে নিজেই প্রকাশ করেন তারুণ্যের সাপ্তাহিক বিচিন্তা। হাজারো তারুণ্যের মানসিক তৃপ্তি সাপ্তাহিক বিচিন্তার পাঠক প্রিয়তা হু হু করে বাড়তেই থাকে। বাংলাদেশে প্রথম প্রথাবিরোধী সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন মিনার মাহমুদ। স্বৈরাচার বিরোধি সাংবাদিকতা বিচিন্তায় পেয়েছিল এক নতুন রূপ। গনগনে তারুণ্যের স্পর্ধা ধারন করে তখন পুরো সপ্তাহে আলোচনায় ছিল বিচিন্তার ইভেস্টিগেট রিপোর্ট। আজকের অনেক মহারথী সাংবাদিকের হাতেখড়ি ছিল সাপ্তাহিক বিচিন্তা। চিন্তার জগতে এক নতুন আলোড়ন তোলা পত্রিকা। কী ছিল না? ভন্ড পীরদের মুখোশ উম্মোচন থেকে রাজনীতি অর্থনীতিসহ সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে।
সবার নিকট সোজা মিনারের নিকট তা ছিল বিপরীত। জীবনাটাকে উল্টে-পাল্টে দেখেছেন। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার প্রথম সুপার স্টারও বলা হয় তাকে। আন্ডার গ্রাউন্ড অপরাধ চক্র, ছাত্র রাজনীতির নেপথ্যের সন্ত্রাস আর চোরাচালান জগতের মুখোশ উম্মোচন করেছিলেন তিনিই প্রথম।
লেখনিতে নির্ভীক, আস্থা বিশ্বাসে রগচটা ও পরনে রংচটা জিন্সের স্মার্ট এক প্রবল তরুন। সংবাদপত্রের মাসুদ রানা মিনার মাহমুদের বিচিন্তায় তারুণ্যপ্রাণ আর আধুনিকতায় ছিল এই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিন্তা। প্রচলিত রাজনীতি আর সমাজ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা আর নির্মোহভাবে ইতিহাস পুর্ণপাঠ করার দুঃসাহস ছিল এই অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত সাংবাদিক গল্পকার মানুষটির।
মিনার মাহমুদের বিচিন্তার তিনটি ইনিংস। রাজকীয় প্রথম ইনিংসটি ছিল কাব্য ও গতিময়। স্বৈরাচার আর রাজাকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জেল-জুলুম সহ্য করে দেশে এলো গণতান্ত্রিক সরকার। নতুন বোতলে পুরনো গল্পের অবতারনা।
শুরু হলো দ্বিতীয় ইনিংস- একের পর এক মামলায় হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত মিনার। তার উপর নববধূ তসলিমা নাসরিনের সাথে “সুখের অসুখ” এ আক্রান্ত মিনার মাহমুদ বিচিন্তার দ্বিতীয় ইনিংস বিরতি দিয়ে দেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে যান।
ডিজিটাল ধ্বস্তধস্তিতে ক্লান্ত হয়ে ১৮ বছরের দাসত্বের জীবন শেষ করে ২০০৯ এর এক সন্ধ্যায় প্রিয় জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন এক বুক আশা নিয়ে। আমেরিকার জীবন একবারে চলে এসেছিলেন প্রিয় স্বদেশে আবার নতুন একটা কিছু করবেন বলে।
এসেই ধাক্কা! সাংবাদিকতা বদলে গেছে। বদলে গেছে মূল্যবোধ। বদলে গেছে সাংবাদিকতার নিষ্ঠা চর্চার প্রয়োগ। তারপরও শুরু করলেন বিচিন্তার তৃতীয় ইনিংস। করপোরেট ও বাণিজ্যিক সাংবাদিকতা দেখে মিনার মাহমুদের স্নায়ু চাপ বাড়ে। বিজ্ঞাপনের জন্য সম্পাদককে যেতে হবে প্রতিষ্ঠানের কাছে, এটা ছিল তার কাছে অকল্পনীয়। বিজ্ঞাপন ছাপা হলে ঐ কোম্পানীর বিরুদ্ধে কিছু লেখা যাবে না-এটাও আপোষকামি সাংবাদিকতা মিনার মাহমুদ মেনে নিতে পারেন নি। সুতরাং তৃতীয় ইনিংসে সরাসরি বোল্ড।
মিনার মাহমুদের হাতে গড়া সাংবাদিকদের অনেকেই এখন মহাতারকা। কেউ সম্পাদক, কেউ প্রধান নির্বাহী, কেউ হেড অব নিউজ! এদের নিয়ে মিনার মাহমুদের গর্বের শেষ ছিল না। এককালের সহকর্মীদের নিকট মিনার মাহমুদের প্রত্যাশা ছিল- একটা চেয়ার টেবিলের। কিন্তু মিনারকে সামলানোর ঝুঁকি কে নেবে?
মিনার মাহমুদের বন্ধুদের কেউ কেউ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিনার মাহমুদের টাকার চেয়ে প্রয়োজন বেশি ছিল একটা লেখার টেবিল ও একটু সবার একটা চেয়ারের। যেখানে তিনি আবার একজন দুর্দান্ত সাংবাদিক হয়ে উঠতে পারবেন। পারবেন ঘুণেধরা এই পচাগলা সমাজকে পরিবর্তন করার সাহসী লেখনি চালিয়ে নিতে।
২০১২ সালের ২৯ মার্চ মিনার মাহমুদ নিজেই নিজের জীবনের ইতি টানলেন। কোন কিছুতেই আপোষ করেন নি কখনো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী আপোষ করেই গেলেন? আপোষ মেনে নিলেন?
না। মৃত্যুতেও মিনার মাহমুদ আপোষ করেননি। এই দেশের সব তারকা সাংবাদিকদের চোখের সামনে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যে তার বিকল্প তিনি নিজেই। যারা তার হাতের সৃষ্টি, তার হাতে গড়া- জীবনের বাহাদুরিতে সব স্টার হয়ে সমাজের উপরি মহলে বসে আছেন তিনি তাদের তিনি অব্যাহতি দিয়ে গেছেন।তিনি কারো করুণার অপেক্ষা করেননি। তিনি তাদের দেখিয়ে দিয়েছেন মিনার মাহমুদ নিজেকে সৃষ্টি করেছেন, নিজে আবার নিজেই নিজেকে বিনাশ করতে পারেন। তবু কারো দ্বারে দ্বারে যেতে পারেন না।
জীবন ও যাপনে এক ও অদ্বিতীয় মিনার মাহমুদ বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে অবস্মরনীয় কিংবদন্তী। তার গল্প তার সাহস তার সততা তার মাতলামি তার প্রেম অপ্রেম দ্রোহ ক্ষোভ তাকে এক উজ্জ্বলতায় নিয়ে গেছে। কেউ কি তাকে আর স্পর্শ করতে পারে?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিন্তা