অন্ধকারের রাত। দূর থেকে ভেসে আসছে বাঘ আর সিংহের হুঙ্কার। তা শুনে ভয়ে ছোটাছুটি করেছে নাম না জানা বন্যপ্রাণীরা। হঠাৎ ক্ষুধার্ত কয়েকটি বাঘ বা সিংহ আপনার উপর আছড়ে পড়ল শিকারের আশায়, কিন্তু না পারল না, আপনি আছেন দূরত্বেই। আপনি তো ভয়ে অজ্ঞান! এমন সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আপনাকে পাইয়ে দেওয়ার জন্যই মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় 'নাইট সাফারি'র চালুর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
সেই ১৯৫০ সালের ভাবনাকে সঙ্গী করে এখনো চলছে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা। বিশ্বে বদলে গেছে। বদলে গেছে চিড়িয়াখানার সেকেলে চিন্তাভাবনাও। এখন থিম হচ্ছে, প্রাণীগুলা মনে করবে যেন একটা ফ্রি জোনে আছে। মানুষও মনে করবে একটা ফ্রি জোনে আছে। ফ্রি জোনে থাকার কারণে মনে হবে বনের মধ্যেই আছে। আর এমন ভবনা সামনে রেখেই মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানার খোলনলচে বদলে ফেলার মহাপরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে।
জাতীয় চিড়িয়াখানা নিয়ে মাস্টার প্ল্যান তৈরির যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেটির প্ল্যান ডিসেম্বর নাগাদ হাতে আসবে। বর্তমানে চিড়িয়াখানার মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজটি করছে সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানি।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ড. মো. আবদুল লতিফ দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘জাতীয় চিড়িয়াখানা নিয়ে একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে। মাস্টার প্ল্যানটি যখন বাস্তবায়ন হবে, তখন চিড়িয়াখানার আমূল পরিবর্তন হবে। এই চিড়িয়াখানাকে আমরা পাঁচটি ভাগে ভাগ করব। ভাগ হওয়ার পর সেখানে বাংলাদেশ হ্যাবিটেট নাম দিয়ে সুন্দরবনকেন্দ্রিক প্রাণীগুলো এক জায়গায় রাখব। আফ্রিকান হেরিটেড অথবা ওকাভান্ডা হেরিটেড নাম দিয়ে আফ্রিকান ও অস্ট্রেলিয়ান যে প্রাণীগুলো আছে, সেগুলো একটি জোনে রেখে ভাগ করব।’
নাইট সাফারির কথাও চিন্তা করা হচ্ছে জানিয়ে ড. মো. আবদুল লতিফ বলেন, ‘নাইট সাফারিতে কিছু পিট অ্যানিমেল রাখবো। সেখানে বেক অব হাউজ থাকবে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং স্টোর থাকবে, গ্যারেজ থাকবে, অফিসে যাতায়াতের জন্য আলাদা রোড থাকবে। চিড়িয়াখানার পুরো বাউন্ডারিটি পাইলিং সিস্টেমের মাধ্যমে করা হবে। এর ফলে সেখান থেকে বাইরের কোনো সুয়ারেজ চিড়িয়াখানার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। এছাড়া বাফার জোন এবং ওয়াকওয়েও থাকবে।’
‘নাইট সাফারি জোন চালু থাকবে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। সেজন্য আলাদা টিকেটের ব্যবস্থাও থাকবে’ বলেও জানান তিনি।
মাস্টার প্ল্যানের মধ্যে দুটি লেক আধুনিকায়নের বিষয়টিও রয়েছে জানিয়ে চিড়িয়াখানার পরিচালক বলেন, ‘আমরা চিন্তা করছি মাস্টার প্ল্যানের মধ্যে চিড়িয়াখানার লেক দুটিকে আধুনিকায়ন করব। এখানে সাউন্ডলেস কয়েকটি বোট দিব। ভাসমান কিছু রেস্তোরার কথাও চিন্তা করা হচ্ছে। চিড়িয়াখানার দুটি লেকে ডলফিন শো করার ভাবনা আছে। এটি হলে দর্শনার্থীরা এসে ডলফিন শো দেখতে পারবেন। ডলফিন শোটি ব্যাংককের সাফারি ওয়ার্ল্ডের আদলে তৈরি করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারলে পুরো চিড়িয়াখানার চিত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। তখন চিড়িয়াখানার দুটি গেট করা হবে। আমাদের দেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এ ধারা অব্যাহত রেখেই চিড়িয়াখানার উন্নয়ন করা হবে। ঢাকায় বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা আধুনিকায়নের মহাপরিকল্পনা তৈরিতে ২০১৯ সালে বার্নার্ড হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। এরপর প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা কয়েক দফা চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ প্রায় শেষ করেছে।’
এই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, জাতীয় চিড়িয়াখানাকে সিঙ্গাপুর চিড়িয়াখানার আদলে গড়ে তোলা হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রাণীদের বিচরণের জন্য খাঁচার বদলে থাকবে আলাদা আলাদা বন্য পরিবেশ। ঘন গাছপালার পাশাপাশি জলজ প্রাণীর জন্য থাকবে হ্রদ।
কবে নাগাদ চিড়িয়াখানার রূপ বদলানোর কাজ শুরু হতে পারে জানতে চাইলে আব্দুল লতিফ বলেন, ‘যদি আমরা এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি (মহাপরিকল্পনা) হাতে পাই, তবে ধাপে ধাপে কাজ শেষ করা হবে। আধুনিক চিড়িয়াখানা বলতে যা বোঝানো হয়, আমরা সেটাই করব। সেখানে সাফারি পার্কও থাকবে। উন্নত দেশের মতো জাতীয় চিড়িয়াখানায় থাকবে ডিজিটাল ম্যাপ।’
এক প্রশ্নের জবাবে ড. মো. আবদুল লতিফ বলেন, ‘এখানে যোগ দেওয়ার আগে খবরের কাগজে দেখতাম যে, চিড়িয়াখানায় নোংরা ও দুর্গন্ধে ভরা, প্রাণীগুলোর স্বাস্থ্য খারাপ ছিলো, পর্যটকরা এসে সেবা পেতেন না। এর মধ্যে কিছু প্রোপাগান্ডাও ছিল, আবার কিছু সত্যতাও ছিল। আমি এখানে আসার পরে তিন-চারটি বিষয়ের ওপর জোড় দিয়েছি। প্রয়োজন অনুযায়ী জাতীয় চিড়িয়াখানার লোকবল সীমিত। আমি চিড়িয়াখানার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে একটা টিম স্পিরিট বাড়িয়েছি। দ্বিতীয়ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে জোড় দিয়েছি। তৃতীয়ত, প্রত্যেকটি প্রাণীর স্বাস্থ্যসেবার দিকে নজর দিয়েছি। প্রত্যেকটি প্রাণীকে ঠিকঠাকভাবে খাবার দিয়েছি।’
সিটিজেন চার্টার থেকে জানা যায়, ১৮৬ দশমিক ৬৩ একরের চিড়িয়াখানায় প্রায় তিন হাজার প্রাণীর বাস। এখানে ১৮ প্রজাতির তৃণভোজি, ১১ প্রজাতির মাংসাশী, ২৫ প্রজাতির ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ, ৫৮ প্রজাতির পাখি ও ২৬ প্রজাতির অ্যাকুয়ারিয়াম মাছ আছে।