ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে-স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি ভালোবাসি ভালোবাসি..
ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার মতো করে হয়তো আর কোনোভাবেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাঁর সাহিত্যে ভালোবাসার উপস্থাপনা পাঠকদের বিমোহিত করে। সাহিত্য জগতের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ প্রেমের জগতেও বিচরণ করেছেন সদর্পে। আজীবন সৃষ্টিশীল রবীন্দ্রনাথ প্রেমের আবেগে ভেসেছেন। উথাল পাতাল প্রেম এসেছে তাঁর জীবনে বহুবার।
রবি ঠাকুরের জ্যোতি দাদার সহধর্মিণী কাদম্বরী দেবী যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে পা রাখলেন তখন রবীন্দ্রনাথ ১৪ বছর বয়সী কিশোর। বৌঠান কাদম্বরী দেবীও তাঁর সমবয়সী। বয়ঃসন্ধির সংবেদনশীল পর্যায়ে রবি ঠাকুরের কিশোর মনে কাদম্বরীর প্রভাব পড়ে বেশ। কাদম্বরীকে রবীন্দ্রনাথের স্থপতি বলে অভিহিত করেন অনেকে। নতুন বৌঠানকে ঘিরেই কবির অনেক সাহিত্যের সৃষ্টি হয়।
দু’জনের মধ্যে বোঝাপড়ার চিত্র পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘চারুলতা’ আর নষ্টনীড়ে দেখা যায়। পরে ‘ভগ্ন হৃদয়’ গীতি কাব্যের উৎসর্গপত্রে তাঁকে লক্ষ্য করে অনায়াসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডাকতেন ‘হেকেটি ঠাকরুন’ বলে। বৌঠান তাঁকে ডাকতেন ‘ভানু’ নামে। এ নামকরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘আমরা যাহাকে ভালবাসি, তাহার একটা নতুন নামকরণ করিতে চাই।’
রবীন্দ্র জীবনে এ নিখাঁদ ভালোবাসাবাসির করুণ পরিণতি হয় কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার পর। ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল জোড়া সাকোঁর ঠাকুর বাড়িতে আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন কাদম্বরী দেবী।
অসংখ্য রবীন্দ্র রচনার মধ্যে অন্তত সাতটি গ্রন্থ একই ব্যক্তি কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এক লেখক তাঁর সাত-সাতটি গ্রন্থ একই ব্যক্তির উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন এ ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বোধ করি বিরল। রবীন্দ্র মানসে কাদম্বরী দেবী সেই বিরলতম ব্যক্তিত্ব।
পরবর্তীতে ১৭ বছরের তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়েন মারাঠি তরুণী আন্না তড়খড়। মারাঠি তরুণীর প্রেমে নীরব সাড়া প্রকাশ পায় রবি ঠাকুরের। প্রেমিকা আন্নাকে নাম দেন ‘নলিনী’। বয়সে বড়, অসামান্য সুন্দরী, বিদূষী, বুদ্ধিমতি, রূপ লাবণ্যে ভরপুর এবং বিলাতফেরত তরুণী আন্নার কাছে ইংরেজি বলা-কওয়ার পাঠ নেওয়ার পাশাপাশি প্রেমের পাঠও রবীন্দ্রনাথ নিয়েছিলেন। কবির প্রথম জীবনে রচিত বহুকাব্য-কবিতায়-নাটকে নলিনী নামের উল্লেখ পাওয়া যায় সে কারণেই। কবি কাব্যের ‘গাঁথুনি’তে রচনা করেছিলেন- ‘শুন নলিনী, খোলো গো আঁখি-- ঘুম এখনো ভাঙিল না কি!’। আন্নার সাথে কবির প্রেম ছিল মাত্র এক মাসের সামান্য কিছু বেশি সময়।
১৮৭৮ সালে ‘পুনা’ স্টিমারযোগে বিলেতে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আলেকজান্দ্রিয়া, ব্রিন্দিষি, প্যারিস ঘুরে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের সাসেক্স কাউন্টির সমুদ্র তীরবর্তী শহর ব্রাইটনে মেজ বৌঠান জ্ঞানদা নন্দিনীর বাসায় এসে পৌঁছালেন ১০ অক্টোবর নাগাদ ব্রাইটন আর হোভ-এরগা-লাগাও ‘মেদিনা ভিলা’র বাড়িগুলোর একটিতে। রবীন্দ্রনাথ তখন আঠারো বছরের তরুণ। বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানেও হৃদয়ের লেনদেন হয় স্কট কন্যা লুসির সাথে।
এমন কি বয়সে ২৯ বছরের ছোট ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথেও রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গুঞ্জন ছিল। ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়েন ভিক্টোরিয়া। আর্জেন্টিনা ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ ৬৩ বছরের প্রবীণ। আর্জেন্টিনার প্লাতা নদীর ধারে বিদেশি কন্যা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে কবি বেশ আপন করে নিয়েছিলেন। ক’দিনের মধ্যেই মেয়ের বয়সী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গ নারী। কবি তাঁর নতুন নাম দেন বিজয়া। পুরবী কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেন ‘বিজয়ার’ করকমলে।
রবীন্দ্রনাথের সাথে হেমন্ত বালা রায় চৌধুরীর সম্পর্কের কথাও তুলে এনেছেন রবীন্দ্র জীবনী গবেষকরা। হেমন্তবালা রবীন্দ্র ভাবনার গুণমুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন। দু’জনের মধ্যে আলাপ হতো পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে। কবিকে হেমন্ত বালা ডাকতেন ‘কবি দাদা’ বলে।
স্ত্রী মৃণালিনীর সমবয়সী ভ্রাতুস্পুত্রী ইন্দিরার সাথেও মনের দিক থেকে কবির আত্মিক সম্পর্ক ছিল। মেজ দাদা সতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি চিঠি পড়েই তা জানতে পারা যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্থানাধিকারিণী ‘পদ্মাবতী’ স্বর্ণপদক পাওয়া ইন্দিরা বহুদিন অনুঢ়া ছিলেন। ইন্দিরা যেমন সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন তেমনি ছিলেন সঙ্গীত চর্চায় আগ্রহী। সেই জন্যই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে ইন্দিরার বিয়ে হয় সেকালের ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর সাথে।
জীবনের শেষ ভাগে রানু অধিকারীর সাথে রবীন্দ্রনাথের মনের মিলন ঘটে। কলকাতায় গিয়ে সেই কিশোরী পৌঢ় কবির সান্নিধ্য পেয়েছে। অনেক রবীন্দ্র গবেষকই মনে করেন তাদের মধ্যে একটি ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য সৃষ্টিকর্মগুলোতে উঠে এসেছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমের আবেশ। কবি প্রেমকে দেখেছেন জীবনের দর্শন খুঁজে পেতে। তাঁর সঙ্গীত ও সাহিত্যকর্মের অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে প্রেম। সেই প্রেম সার্বজনীন, পবিত্র, সরল ও আবেগময়। রবীন্দ্র সাহিত্যে আমরা যে প্রেমের ধারায় ভাসি তার স্রোতে মিশে আছে অনেক বৈচিত্র্যময় প্রেমের অনুভূতি।
প্রেম বুভুক্ষু এক কবির জীবনের প্রেম সফল না বিফল সে নিয়ে নানা মত থাকলেও বিশ্ব কবির যে প্রেম বাংলা সাহিত্যকে জড়িয়ে রেখেছে আজও সেই প্রেমের কোনো কমতি নেই। সেই প্রেম আজও মানুষের মনে ভালোবাসার জন্ম দেয়। আজও সেই কবিতা-গানের সুরে মনের কথা বিনিময় হয়।